রাজা বললেন, “তোমায় খবর দেয় নি ব’লে কাঁদছিলে, তুমি থাকলে করতে কি?” লোকটা বলল, “মহারাজ, সে কথা বললে যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তাই বলতে সাহস হয় না।”
রাজা বললেন, “যে বিশ্বাস করবে না, তার মাথা কাটা যাবে- তুমি নির্ভয়ে বলে ফেল।” সভাসুদ্ধ লোক তাতে হাঁ হাঁ করে সায় দিয়ে উঠল।
লোকটা তখন বলল, “মহারাজ, আমি একটা মন্ত্র জানি, আমি যুগজন্ম ধরে বসে আছি, দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে সেই মন্ত্র তাকে যদি বলতে পারতাম তা হলে কি যে আশ্চর্য কাণ্ড হত তা কেউ জানে না। কারণ, তার কথা কোন বইয়ে লেখে নি। হায় রে হায়, এমন সুযোগ আর কি পাব?” রাজা বললেন, “মন্ত্রটা আমায় বল তো।” লোকটা বলল, “সর্বনাশ! সে মন্ত্র দ্রিঘাংচুর সামনে ছাড়া কারুর কাছে উচ্চারণ করতে নেই। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি- আপনি দু’দিন উপোস ক’রে তিন দিনের দিন সকালে উঠে সেটা পড়ে দেখবেন। আপনার সামনে দাঁড়কাক দেখলে, তাকে আপনি মন্ত্র শোনাতে পারেন, কিন্তু খবরদার, আর কেউ যেন তা না শোনে- কারণ, দাঁড়কাক যদি দ্রিঘাংচু না হয়, আর তাকে মন্ত্র বলতে গিয়ে অন্য লোকে শুনে ফেলে, তা হলেই সর্বনাশ!”
তখন সভা ভঙ্গ হল। সভার সকলে এতক্ষণ হাঁ ক’রে শুনছিল, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল; সকলে দ্রিঘাংচুর কথা, মন্ত্রের কথা আর আশ্চর্য ফল পাওয়ার কথা বলা-বলি করতে করতে বাড়ি চলে গেল।
তারপর রাজামশাই দু’দিন উপোস করে তিন দিনের দিন সকালবেলা- সেই লোকটার লেখা কাগজখানা খুলে পড়লেন। তাতে লেখা আছে-
“হল্দে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাট্কেল চিত্ পটাং
মুস্কিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।”
রাজামশাই গম্ভীরভাবে এটা মুখস্থ করে নিলেন। তারপর থেকে তিনি দাঁড়কাক দেখলেই লোকজন সব তাড়িয়ে তাকে মন্ত্র শোনাতেন, আর চেয়ে দেখতেন কোনরকম আশ্চর্য কিছু হয় কি না! কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি দ্রিঘাংচুর কোনো সন্ধান পান নি।
নন্দলালের মন্দ কপাল
নন্দলালের ভারি রাগ, অঙ্কের পরীক্ষায় মাস্টার তাহাকে গোল্লা দিয়াছেন। সে যে খুব ভালো লিখিয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু তা বলিয়া একেবারে গোল্লা দেওয়া কি উচিত ছিল? হাজার হোক সে একখানা পুরা খাতা লিখিয়াছিল তো ! তার পরিশ্রমের কি কোনো মূল্য নাই? ঐ যে ত্রৈরাশিকের অঙ্কটা, সেটা তো তার প্রায় ঠিকই হইয়াছিল, কেবল একটুখানি হিসেবের ভুল হওয়া উত্তরটা ঠিক মেলে নাই। আর ঐ যে একটা ডেসিমাল অঙ্ক ছিল, সেটাতে গুণ করিতে গিয়া সে ভাগ করিয়া বসিয়াছিল, তাই বলিয়া কি একটা নম্বরও দিতে নাই? আরও অন্যায় এই যে, এই কথাটা মাস্টার মহাশয় ক্লাশের ছেলেদের কাছে ফাঁস করিয়া ফেলিয়াছেন। কেন? আর একবার হরিদাস যখন গোল্লা পাইয়াছিল, তখন সে তো কথাটা রাষ্ট্র হয় নাই !
সে যে ইতিহাসের একশোর মধ্যে পঁচিশ পাইয়াছে, সেটা বুঝি কিছু নয়? খালি অঙ্ক ভালো পারে নাই বলিয়াই তাহাকে লজ্জিত হইতে হইবে? সব বিষয়ে যে সকলকে ভালো পারিতে হইবে তাহারৈ বা অর্থ কি? স্বয়ং নেপোলিয়ান যে ছেলেবেলায় ব্যাকরণে একেবারে আনাড়ী ছিলেন, সে বেলা কি? তাহার এও যুক্তিতে ছেলেরা দমিল না, এবং মাস্টারের কাছে এই তর্কটা তোলাতে তাঁহারাও যে যুক্তিটাকে খুব চমৎকার ভাবিলেন, এমন বোধ হইল না। তখন নন্দলাল বলিল, তাহার কপালই মন্দ— সে নাকি বরাবর তাহা দেখিয়া আসিয়াছে।
সেই তো যেবার ছুটির আগে তাহাদের পাড়ায় হাম দেখা দিয়াছিল, তখন বাড়িসুদ্ধো সকলেই হামে ভুগিয়া দিব্যি মজা করিয়া স্কুল কামাই করিল, কেবল বেচারা নন্দলালকেই নিয়মমতো প্রতিদিন স্কুলে হাজিরা দিতে হইয়াছিল। তারপর যেমন ছুটি আরম্ভ হইল, অমনি তাহাকে জ্বরে আর হামে ধরিল— ছুটির অর্ধেকটাই মাটি ! সেই যেবার সে মামার বাড়ি গিয়াছিল, সেবার তাহার মামাতো ভাইয়েরা কেহ ছিল না- ছিলেন কোথাকার এক বদমেজাজি মেশো, তিনি উঠিতে বসিতে কেবল ধমক আর শাসন ছাড়া আর কিছুই জানিতেন না। তাহার উপর সেবার এমন বৃষ্টি হইয়াছিল, একদিনও ভালো করিয়া খেলা জমিল না, কোথাও বেড়ানো গেল না। এই জন্য পরের বছর যখন আর সকলে মামার বাড়ি গেল তখন সে কিছুতেই যাইতে চাহিল না। পরে শুনিল সেবার নাকি সেখানে চমৎকার মেলা বসিয়াছিল, কোন রাজার দলের সঙ্গে পঁচিশটি হাতি আসিয়াচিল, আর বাজি যা পোড়ানো হইয়াছিল সে একেবারে আশ্চর্যরকম ! নন্দলালের ছোট ভাই যখন বার বার উৎসাহ করিয়া তাহার কাছে এই সকলের বর্ণনা করিতে লাগিল, তখন নন্দ তাহাকে এক চড় মাড়িয়া বলিল, “যা যা ! মেলা বক্বক্ করিসনে !” তাহার কেবল মনে হইতে লাগিল সেবার সে মামার বাড়ি গিয়াও ঠকিল, এবার না গিয়াও ঠকিল ! তাহার মতো কপল-মন্দ আর কেহ নাই।
স্কুলেও ঠিক তাই। সে অঙ্ক পারে না- অথচ অঙ্কের জন্য দুই-একটা প্রাইজ আছে- এদিকে ভুগোল ইতিহাস তাহার কণ্ঠস্থ কিন্তু ঐ দুইটার একটাতেও প্রাইজ নাই। অবশ্য সংস্কৃতেও সে নেহাত কাঁচা নয়, ধাতু প্রত্যয় বিভক্তি সব চট্পট্ মুখস্থ করিয়া ফেলে- চেষ্টা করিলে কি পড়ার বই আর অর্থ-পুস্তকটাকেও সড়গড় করিতে পারে না? ক্লাশের মধ্যে ক্ষুদিরাম একটু আধটু সংস্কৃত জানে- কিন্তু তাহা তো বেশি নয়। নন্দলাল ইচ্ছা করিলে কি তাহাকে হারাইতে পারে না? নন্দ জেদ করিয়া স্থির করিল, ‘একবার ক্ষুদিরামকে দেখে নেব। ছোকরা এ বছর সংস্কৃতের প্রাইজ পেয়ে ভারি দেমাক করছে— আবার অঙ্কের গোল্লার জন্য আমাকে খোঁটা দিতে এসেছিল। আচ্ছা, এবার দেখা যাবে।’
নন্দলাল কাহাকেও কিছু না জানাইয়া সেইদিন হইতেই বাড়িতে ভয়ানক ভাবে পড়িতে শুরু করিল। ভোরে উঠিয়াই সে ‘হসতি হসত হসন্তি’ শুরু করে, রাত্রেও ‘অস্তি গোদাবরী তীরে বিশাল শল্মলীতরু’ বলিয়া ঢুলিতে থাকে। কিন্তু ক্লাশের ছেলেরা এ কথার বিন্দুবিসর্গও জানে না। পণ্ডিত মহাশয় যখন ক্লাশে প্রশ্ন করেন, তখন মাঝে মাঝে উত্তর জানিয়াও সে চুপ করিয়া মাথা চুলকাইতে থাকে, এমন কি কখনো ইচ্ছা করিয়া দুই-একটা ভুল বলে, পাছে ক্ষুদিরাম তাহার পড়ার খবর টের পাইয়া আরও বেশি করিয়া পড়ায় মন দিতে থাকে। তাহার ভুল উত্তর শুনিয়া ক্ষুদিরাম মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে, নন্দলাল তাহার কোনো জবাব দেয় না; কেবল ক্ষুদিরাম যখন নিজে যখন এক-একটা ভুল করে, তখন সে মুচকি মুচকি হাসে, আর ভাবে, ‘পরীক্ষার সময় অম্নি ভুল করলেই এবার ওঁকে সংস্কৃতের প্রাইজ আর পেতে হবে না।’
ওদিকে ইতিহাসের ক্লাশে নন্দলালের প্রতিপত্তি কমিতে লাগিল। কারণ, ইতিহাস আর ভুগোল নাকি এক রকম শিখিলেই পাশ করা যায়— তাহার জন্য নন্দর কোনো ভবনা নাই। তাহার সমস্ত মনটা রহিয়াছে ঐ সংস্কৃত পড়ার উপরে— অর্থাৎ সংস্কৃত প্রাইজটার উপরে ! একদিন মাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কি হে নন্দলাল, আজকাল বুঝি বাড়িতে কিছু পড়াশুনা কর না? সব বিষয়েই সে তোমার এমন দুর্দশা হচ্ছে তার অর্থ কি?” নন্দ আর একটু হইলেই বলিয়া ফেলিত, “আজ্ঞে সংস্কৃত পড়ি” কিন্তু কথাটাকে হঠাৎ সামলাইয়া “আজ্ঞে সংস্কৃত— না সংস্কৃত নয়” বলিয়াই সে থতমত খাইয়া গেল। ক্ষুদিরাম তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “কৈ সংস্কৃতও তো কিছু পারে না।” শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ ছেলে হাসিতে লাগিল। নন্দ একটু অপ্রস্তুত হইল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল— ভাগ্যিস্ তাহার সংস্কৃত পড়ার কথাটা ফাঁস হইয়া যায় নাই।
দেখিতে দেখিতে বছর কাটিয়া আসিলে, পরীক্ষার সময় প্রায় উপস্থিত। সকলে পড়ার কথা, পরীক্ষার কথা আর প্রাইজের কথা বলাবলি করিতেছে, এমন সময় একজন জিজ্ঞাসা করিল, “কি হে! নন্দ এবার কোন প্রাইজটা নিচ্ছ?” ক্ষুদিরাম নন্দর মতো গলা করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “আজ্ঞে সংস্কৃত— না সংস্কৃত নয়।” সকলে হাসিল, নন্দও খুব উৎসাহ করিয়া সেই হাসিতে যোগ দিল। মনে ভাবিল, ‘বাছাধন, এ হাসি আর তোমার মুখে বেশিদিন থকছে না।’
যথাসময়ে পরীক্ষা আরম্ভ হইল এবং যথাসময়ে শেষ হইল। পরীক্ষার ফল জানিবার জন্য সকলে আগ্রহ করিয়া আছে, নন্দও রোজ নোটিশবোর্ডে গিয়া দেখে, তাহার নামে সংস্কৃত প্রাইজ পাওয়ার কোনো বিজ্ঞাপন আছে কিনা। তারপর একদিন হেডমাস্টার মহাশয় এক তাড়া কাগজ লইয়া ক্লাশে আসিলেন, আসিয়াই গম্ভীর ভাবে বলিলেন, এবার দুই-একটা নতুন প্রাইজ হয়েছে আর অন্য বিষয়েও কোনো কোনো পরিবর্তন হয়েছে।” এই বলিয়া তিনি পরীক্ষার ফলাফল পড়িতে লাগিলেন। তাহাতে দেখা গেল, ইতিহাসের জন্য কে যেন একটা রূপার মেডেল দিয়াছেন। ক্ষুদিরাম ইতিহাসে প্রথম হইয়াছে, সে-ই ঐ মেডেলটা লইবে। সংস্কৃতে নন্দ প্রথম, ক্ষুদিরাম দ্বিতীয়— কিন্তু এবার সংস্কৃতে কোনো প্রাইজ নাই।
হায় হায় ! নন্দর অবস্থা তখন শোচনীয় ! তাহার ইচ্ছা হইতেছিল সে ছুটিয়া গিয়া ক্ষুদিরামকে কয়েকটা ঘুঁষি লাগাইয়া দেয়। কে জানিত এবার ইতিহাসের জন্য প্রাইজ থাকিবে, আর সংস্কৃতের জন্য থাকিবে না। ইতিহাসের মেডেলটা তো সে অনায়াসেই পাইতে পারিত। কিন্তু তাহার মনের কষ্ট কেহ বুঝিল না— সবাই বলিল, “বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে— কেমন করে ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেয়েছে।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া নন্দ বলিল, “কপাল মন্দ!”
নাপিত পন্ডিত
বাগদাদ শহরে এক ধনীর ছেলে প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিল— সে কাজীর মেয়েকে বিবাহ করিবে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা যত সহজ, কাজটা তত সহজ নয়— সুতরাং কিছুদিন চেষ্টা করিয়াই সে বেচারা একেবারে হতাশ হইয়া পড়িল। দিনে আহার নাই, রাত্রে নিদ্রা নাই— তার কেবলই ঐ এক চিন্তা— কী করিয়া কাজীর মেয়েকে বিবাহ করা যায়।
বিবাহের সব চাইতে বড় বাধা কাজী সাহেব স্বয়ং। সকলেই বলে, “বাপু হে! কাজী সাহেব এ স্পর্ধার কথা জানতে পারলে তোমার একটি হাড় আস্ত রাখবেন না।” বেচারা কী করে? ক্রমাগত ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে রীতিমত জ্বর আনিয়া ফেলিল— বন্ধু-বান্ধব বলিতে লাগিল, “ছোকরা বাঁচলে হয়।” ইহার মধ্যে হঠাৎ একদিন এক বুড়ি আসিয়া খবর দিল, বিবাহের সমস্তই ঠিক। কাজী সাহেবকে না জানাইয়াই এখন চুপচাপ বিবাহটা হইয়া যাক— তারপর সুবিধামত তাঁহাকে খবর দেওয়া যাইবে; তখন তিনি গোল করিয়া করিবেন কি? সে আরও বলিল, “শুক্রবার সন্ধ্যার সময় কাজী সাহেব বাড়ি থাকবেন না— সেই সময় বিয়েটা সেরে ফেল— কিন্তু খবরদার! কাজীসাহেব যেন এসব কথার বিন্দুমাত্র জানতে না পারেন।”
শুক্রবার দিন ভোর না হইতে বর বেচারা হাত মুখ ধুইয়া প্রস্তুত, সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহার আর সবুর সয় না। দুপুর না হইতেই সে চাকরকে বলিল, “একতা নাপিত ডেকে আন্। এখন থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকি।” চাকর তাড়াতাড়ি কোথ হইতে এক নাপিত আনিয়া হাজির করিল।
নাপিত আসিয়াই বরকে বলিল, “আপনাকে বড় কাহিল দেখছি— যদি অনুমতি করেন ত’ ছুরি দিয়ে বাঁ হাতের একটুখানি রক্ত ছাড়িয়ে দিই— তা হলেই সমস্ত শরীরটা ঠান্ডা বোধ করবেন।” বর বলিল, “না হে, তোমাকে চিকিৎসার জন্য ডাকি নাই— আমার দাড়িতা একটু চট্পট্ কামিয়ে দাও দেখি।” নাপিত তখন তাহার সরঞ্জামের থলি খুলিয়া অনেকগুলা ক্ষুর বাহির করিল, তারপর প্রত্যেকটা ক্ষুর হাতে লইয়া বার বার পরীক্ষা করিতে লাগিল। এইরূপে অনেক সময় নষ্ট করিয়া সে একটা বাটির মত কী একটা বাহির করিল। বর ভাবিল, এইবার বাটিতে জল দিয়া কামান শুরু করিবে। কিন্তু নাপিত তাহার কিছুই করিল না; সে অদ্ভুত একটা কাঁটা-কম্পাসের মানযন্ত্র লইয়া ঘরের বাহিরে উঠানের মাঝখানে গিয়া, সূর্যের গতিবিধির কী সব হিসাব করিতে লাগিল। তারপর আবার গম্ভীরভাবে ঘরে আসিয়া বলিল, “মহাশয়, হিসাব ক’রে দেখলাম, এই বৎসর এই মাসে এই শুক্রবারের ঠিক এই সময়টি অতি চমৎকার শুভক্ষণ— দাড়ি কামাবার উপযুক্ত সময়। কিন্তু আজ মঙ্গল বুধ গ্রহসংযোগ হওয়াতে আপনার কিছু বিপদের সম্ভাবনা দেখছি।”
কাজের সময় এরকম বক্বক্ কারিলে কাহার না রাগ হয়? বিবাহার্থী ছোকরাটি রাগিয়া বলিল, “বাপু হে, তোমাকে কি বক্তৃতা শোনাবার জন্য না জ্যোতিষ গণনার জন্য ডাকা হয়েছে? কামাতে এসেছ, কামিয়ে যাও।” কিন্তু নাপিত ছাড়িবার পাত্রই নয়, সে অভিমান করিয়া বলিল, “মশাই, এ রকম অন্যায় রাগ আপনার শোভা পায় না। আপনি জানেন আমি কে? আপনি কি জানেন যে বাগদাদ শহরে আমার মত দ্বিতীয় আর কেউ নাই? আমার গুণের কথা শুনবেন? আমি একজন বিচক্ষণ চিকিৎসক, রসায়ন শাস্ত্রে আমার অসাধারণ দখল, আমার জ্যোতিষ গণনা একেবারে নির্ভুল, নীতিশাস্ত্র ব্যাকরণশাস্ত্র তর্কশাস্ত্র, এ সমস্তই আমার কণ্ঠস্থ, জ্যামিতি থেকে শুরু ক’রে বীজগণিত পাটিগণিত পর্যন্ত গণিতশাস্ত্রের কোন তত্ত্বি জানতে বাকি রাখি নি। তার উপর আবার আমি একজন পাকা দার্শনিক পণ্ডিত, আর আমি যে সকল কবিতা রচনা করি, সমঝদার লোকের মুখে তার সুখ্যাতি আর ধরে না।”— নাপিতের এই বক্তৃতার দৌড় দেখিয়া ছোকরাটি ভীষণ রাগের মধ্যেও হাসিয়া ফেলিল। সে বলিল, “তোমার বক্তৃতা শুনবার ফুরসৎ আমার নাই— তুমি কামান শেষ করবে কি না বল, না কর চলে যাও।” নাপিত বলিল, “এই কি আপনার উপযুক্ত কথা হল? আমি কি আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম, না আপনি নিজেই লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়েছিলেন? এখন আমি আপনাকে না কামিয়ে গেলে, আমার মান সম্ভ্রম থাকে কি ক’রে? আপনি সেদিনকার ছেলে, আপনি এসবের কদর বুঝবেন কি? আপনার বাবা যদি আজ থাকতেন তবে আমাকে ধন্য ধন্য বলতেন— কারণ তাঁর কাছে কোন দিনই আমার সম্মানের ত্রুটি হয়নি। আমার এ সকল আমূল্য উপদেশ শুনবার সৌভাগ্য সকলে পায় না— তিনি তা বেশ বুঝতেন। আহা, তিনি কী চমৎকার লোকই ছিলেন! আমার কথাগুলি কত আগ্রহ ক’রে তিনি শুনতেন! আর কত খাতির, কত তোয়াজ ক’রে কত অজস্র বকশিস্ দিয়ে তিনি আমায় খুসি রাখতেন। আপনি ত’ সে সব খবর রাখেন না।” এই রকম বক্তৃতায় সে আরও আধঘণ্টা সময় কাটাইয়া দিল। এদিকে বেলাও বাড়িতেছে, বিবাহের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে; কাজেই বর একেবারে সপ্তমে চড়িয়া বলিল, “যাও! যাও! তোমায় কামাতে হবে না।”
নাপিত তখন তাড়াতাড়ি ক্ষুর লইয়া কামাইতে শুরু করিল। কিন্তু ক্ষুরের দুই চার টান দিয়াই সে আবার থামিয়া বলিল, “মশাই! ওরকম রাগ করা ভাল নয়। ভেবে দেখুন, জ্ঞানে গুণে বয়সে সব বিষয়েই আপনি ছেলেমানুষ। তবে অবশ্যি, আপনার যে রকম তাড়া দেখছি, তাতে বোধহয় আপনি আজকে একটু বিশেষ ব্যস্ত আছেন। এ রকম ব্যস্ততার কারণটা কী জানতে পারলে, আমি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে ঠিক ভালমত ব্যবস্থা করতে পারি।” এই বলিয়াই সে আবার তাহার মানযন্ত্র লইয়া হিসাব করিতে লাগিল। যতই তাড়া দেওয়া যায়, ততই সে বলে, “এই হিসাবটা হল ব’লে।” তখন বেগিতিক দেখিয়া বর বলিল, “আরে, ব্যাপারটা কিছু নয়— আজ রাত্রে আমার এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে— তাই, বড় তাড়াতাড়ি।”
এই কথা শুনিবা মাত্র নাপিত একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সে বলিল, “ভাগ্যিস্ মনে করিয়ে দিলেন! আমার বাড়িতেও যে আজ ছয়জন লোককে নেমন্তন্ন করে এসেছি! তাদের জন্য ত’ কোনরকম বন্দোবস্ত ক’রে আসি নি। এখন, মনে করুন, মাংস কিনতে হবে, রাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে, মিঠাই আনতে হবে;— কখন বা এসব করি, আর কখনই বা আপনাকে কামাই।” বর দেখিল আবার বেগতিক, সে নিরুপায় হইয়া বলিল, “দোহাই তোমার। আর আমায় ঘাঁটিও না— আমার চাকরকে বলে দিচ্ছি— তোমার যা কিছু চাই আমার ভাঁড়ার থেকে সমস্তই সে বা’র ক’রে দেবে— তার জন্য তুমি মিথ্যে ভেব না।” নাপিত বলিল, “এ অতি চমৎকার কথা। দেখুন, হামামের মালিশওয়ালা জান্তৌৎ— আর ঐ যে কড়াইশুঁটি বিক্রী করে, সালি— আর ঐ শিম বেচে, সালৌৎ— আর আখের শা তরকারিওয়ালা আর আবু মেকারেজ ভিস্তি আর পাহারাদার কাশেম— এরা সবাই ঠিক আমার মত আমুদে— এরা কখনও মুখ হাঁড়ি করে থাকে না; তাই এদের আমি নেমন্তন্ন করেছি। আর এদের একটা বিশেষ গুণ যে, এরা ঠিক আমারই মত চুপচাপ থাকে— বেশী বক্বক্ করতে ভাল বাসে না। এক একজন লোক থাকে তারা সব সময়েই বকর্ বকর্ করছে— আমি তাদের দু চক্ষে দেখতে পারি নে। এরা কেউ সেরকম নয়; তবে নাচতে আর গাইতে এরা সবাই ওস্তাদ। জান্তৌৎ কি রকম ক’রে নাচে দেখবেন? ঠিক এই রকম”— এই বলিয়া সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্য ও বিকট সুরে গান করিতে লাগিল। কেবল তাহাই নয়, ঐ ছয়জন বন্ধুর মধ্যে প্রত্যেকে কি রকম করিয়া নাচে ও গায়, তাহার নকল দেখাইয়া তবে সে ছাড়িল। তারপর, হঠাৎ সে ক্ষুরটুর ফেলিয়া ভাঁড়ার ঘরে চাকরের কাছে তাহার নিমন্ত্রণের ফর্দ দিতে ছুটিল। বর ততক্ষণে আধ কামান অবস্থায় ক্ষেপিয়া পাগলের মত হইয়াছে, কিন্তু নাপিত তাহার কথায় কানও দেয় না। সে গম্ভীরভাবে ঘরের হাঁস মুরগী তরিতরকারি হালুয়া মিঠাই সব বাছিয়া বাছিয়া পছন্দ করিতে লাগিল। তারপর আরও অনেক গল্প আর অনেক উপদেশ শুনাইয়া অতি ধীর মেজাজে সাড়ে চার ঘণ্টায় সে তাহার কামান শেষ করিল। আবার যাইবার সময় বলিয়া গেল, “দেখুন, আমার মত এমন বিজ্ঞ, এমন শান্ত, এমন অল্পভাষী হিতৈষী বন্ধু আপনি পেয়েছেন, সেটা কেবল আপনার বাবার পুণ্যে। আজ হ’তে আমি আপনার কেনা হয়ে রইলুম।”
নাপিতের হাত হইতে উদ্ধার পাইয়া বর দেখিল, আর সময় নাই। সে তাড়াতাড়ি বিবাহ করিতে বাহির হইল। লোকজন সঙ্গে লইল না, এবং কাহাকেও খবর দিল না; পাছে কথাটা কোন গতিকে কাজী সাহেবের কাছে ফাঁস হইয়া যায়।
এদিকে নাপিতও কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকে নাই। সে কেবল ভাবিতেছে, “না জানি সে কি রকম নেমন্তন্ন, যার জন্য সে এমন ব্যস্ত, যে আমার ভাল ভাল কথাগুলো পর্যন্ত শুনতে চায় না। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।” সুতরাং বর যখন সন্ধ্যার সময় বাহির হইল, নাপিতও তাহার পিছন পিছন লুকাইয়া চলিল।
বর সাবধানে কাজীর বাড়ি হাজির হইয়া খবর লইল যে কাজীসাহেব বাড়িতে নাই; এদিকে সব আয়োজন প্রস্তুত— তাড়াতাড়ি বিবাহ সারিতে হইবে। দৈবাৎ যদি কাজীসাহেব আসিয়া পড়েন, তাহার জন্য ছাতের উপর পাহারা বসান হইল, তাঁহাকে আসিতে দেখিলেই সে চিৎকার করিয়া সঙ্কেত করিবে এবং বরকে খিড়কী দরজা দিয়া পলাইতে হইবে। এদিকে কিন্তু হতভাগা নাপিতটা বাড়ির বাহিরে থাকিয়া যে আসে তাহাকেই বলে, “তোমরা সাবধানে থেক— আমাদের মনিবটি কেন জানই এই কাজীর বাড়িতে ঢুকেছেন— তাঁর জন্য আমার বড় ভাবনা হচ্ছে।”
বিবাহ আরম্ভ না হইতেই মুখে মুখে এই খবর রটিয়া বাড়ির চারিদিকে ভীড় জমিয়া গেল— তাহা দেখিয়া ছাতের উপরে সেই পাহারাদার ব্যস্তভাবে ডাক দিয়া উঠিল। আর কোথা যায়! তাহার গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্র “কে আছিস রে, আমার মনিবকে মেরে ফেললে রে” বলিয়া নাপিত “হায় হায়” শব্দে আপনার চুল দাড়ি ছিঁড়িতে লাগিল। তাহার বিকট আর্তনাদে চারিদিকে এমন হৈ হৈ পড়িয়া গেল যে স্বয়ং কাজীসাহেব পর্যন্ত গোলমাল শুনিয়া বাড়ি ছুটিয়া আসিলেন। সকলেই বলে ব্যাপার কি? নাপিত বলিল, “আর ব্যাপার কী! ঐ লক্ষ্মীছাড়া কাজী নিশ্চয়ই আমার মনিবকে মেরে ফেলেছে।” তখন মার মার করিয়া সকলে কাজীর বাড়িতে ঢুকিল। বর বেচারা পলাইবার পথ না পাইয়া, ভয়ে ও লজ্জায় একটা সিন্দুকের মধ্যে লুকাইয়া ছিল, নাপিত সেই হাজার লোকের মাঝখানে সিন্দুকের ভিতর হইতে “এই যে আমার মনিব” বলিয়া তাহাকে টানিয়া বাহির করিল। সে বেচারা এই অপমানে লজ্জিত হইয়া যতই সেখান হইতে ছুটিয়া পলাইতে যায়, নাপিত ততই তাহার পিছন পিছন ছুটিতে থাকে আর বলে, “আরে মশাই, পালান কেন? কাজীসাহেবকে ভয় কিসের? আরে মশাই, থামুন না।” ব্যাপার দেখিয়া চারিদিকে লোকজন হাসাহাসি ঠাট্টা তামাসা করিতে লাগিল। কাজীর মেয়েকে বিবাহ করিতে গিয়া, বিবাহ ত’ হইলই না, মাঝে হইতে প্রাণপণে দৌড়াইতে গিয়া, হোঁচট খাইয়া বরের একটা ঠ্যাং খোঁড়া হইয়া গেল। এখানেও তাহার দুর্দশার শেষ নয়, নাপিতটা সহরের হাটে বাজারে সর্বত্র বাহাদুরি করিয়া বলিতে লাগিল, “দেখেছ? ওকে কি রকম বাঁচিয়ে দিলাম। সেদিন আমি না থাকলে কি কাণ্ডই না হ’ত। কাজীসাহেব যে রকম খ্যাপা মেজাজের লোক, কখন কী ক’রে বসত কে জানে। যা হোক, খুব বাঁচিয়ে দিয়েছি।” যে আসে তাহার কাছেই সে এই গল্প জুড়িয়া দেয়।
ক্রমে ছোকরাটির অবস্থা এমন হইল যে, সে কাহাকেও আর মুখ দেখাইতে পারে না— যাহার সঙ্গে দেখা হয় সেই জিজ্ঞাসা করে, “ভাই, কাজীর বাড়িতে তোমার কি হয়েছিল? শুনলাম ঐ নাপিত না থাকলে তুমি নাকি ভারি বিপদে পড়তে।” শেষটায় একদিন অন্ধকার রাত্রে বেচারা বাড়িঘর ছাড়িয়া বাগদাদ সহর হইতে পলাইল, এবং যাইবার সময় প্রতিজ্ঞা করিয়া গেল, “এমন দূর দেশে পলাইব, যেখানে ঐ হতভাগা নাপিতের মুখ দেখিবার আর কোন সম্ভাবনা না থাকে।”
পাগলা দাশু
আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহার মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে পাগলা দাশুকে চিনিয়া লয়। সেবার একজন নূতন দারোয়ান আসিল, একেবারে আনকোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই সে আন্দাজে ঠিক ধরিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু। কারণ তার মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চলনে চালনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু ‘ছিট’ আছে। তাহার চোখদুটি গোল-গোল, কানদুটা অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় এক বস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়—