- বইয়ের নামঃ সুকুমার রায়ের গল্প
- লেখকের নামঃ সুকুমার রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অর্ফিয়ুস
নয়টি বোন ছিলেন, তাঁহারা ছন্দের দেবী। গানের ছন্দ, কবিতার ছন্দ, নৃত্যের ছন্দ, সঙ্গীতের ছন্দ—সকলরকম ছন্দকলায় তাঁহাদের সমান কেহই ছিল না। তাঁহাদেরই একজন, দেবরাজ জুপিটারের পুত্র আপোলোকে বিবাহ করেন।
আপোলো ছিলেন সৌন্দর্যের দেবতা, শিল্প ও সঙ্গীতের দেবতা। তিনি যখন বীণা বাজাইয়া গান করিতেন তখন দেবতারা পর্যন্ত অবাক হইয়া শুনিতেন।
এমন বাপ-মায়ের ছেলে অর্ফিয়ুস যে গান-বাজনায় অসাধারণ ওস্তাদ হইবেন, সে আর আশ্চর্য কি? অর্ফিয়ুসের গুণের কথা দেশ-বিদেশ রটিয়া গেল—স্বয়ং আপোলো খুশী হইয়া তাঁহাকে নিজের বীণাটি দিয়া ফেলিলেন। পাহাড়ে পর্বতে বনে জঙ্গলে অর্ফিয়ুস বীণা বাজাইয়া ফিরিতেন আর সমস্ত পৃথিবী স্তব্ধ হইয়া তাহা শুনিত। অর্ফিয়ুসের বীণার সুরে আকাশ যখন ভরিয়া উঠিত, তখন সুরের আনন্দে গাছে গাছে ফুল ফুটিত, সমুদ্রের কোলাহল থামিয়া যাইত, বনের পশু হিংসা ভুলিয়া অবাক হইয়া পড়িয়া থাকিত।
এই রকমে দেশে দেশে বীণা বাজাইয়া অর্ফিয়ুস ফিরিতেছেন এমন সময় একদিন ইউরিডিস নামে এক আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে তাঁহার বীণার সুরে মোহিত হইয়া দেখিতে আসিলেন, কে এমন সুন্দর বাজায়। ইউরিডিসকে দেখিবামাত্র অর্ফিয়ুসের মন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, তাঁহার আনন্দ বীণার ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে আকাশকে মাতাইয়া তুলিল। তন্ময় হইয়া সঙ্গীত শুনিতে শুনিতে ইউরিডিসের মন একেবারে গলিয়া গেল। তারপর ইউরিডিসের সহিত অর্ফিয়ুসের বিবাহ হইল; মনের আনন্দে দুইজনে দেশ-দেশান্তরে বেড়াইতে চলিলেন।
কিন্তু এ আনন্দ তাঁহাদের বেশীদিন থাকিল না। একদিন মাঠের মধ্যে এক বিষাক্ত সাপ ইউরিডিসকে কামড়াইয়া দিল এবং সেই বিষেই ইউরিডিসের মৃত্যু হইল। অর্ফিয়ুস তখন শোকে পাগলের মত হইয়া পড়িলেন, তাঁহার বীণার তারে হাহাকার করিয়া করুণ সঙ্গীত বাজিয়া উঠিল। কি করিবেন, কোথায় যাইবেন, কিছুই ভাবিয়া না পাইয়া, ঘুরিতে ঘুরিতে অর্ফিয়ুস একেবারে অলিম্পাস্ পর্বতের উপর আসিয়া পড়িলেন। সেখানে দেবরাজ বজ্রধারী জুপিটার তাঁহার দুঃখের গানে ব্যথিত হইয়া বলিলেন, “যাও, পাতালপুরীতে প্রবেশ করিয়া যমরাজ প্লুটোর নিকট তোমার স্ত্রীর জন্য নূতন জীবন ভিক্ষা করিয়া আন। কিন্তু জানিও, এ বড় দুঃসাধ্য কাজ; প্রাণের মায়া যদি থাকে, তবে এমন কাজে যাইবার আগে চিন্তা করিয়া দেখ।”
অর্ফিয়ুস নির্ভয়ে বীণা বাজাইতে বাজাইতে পাতালের দিলে চলিলেন। পাতালপুরীর সিংহদ্বারে যমরাজের ত্রিমুণ্ড কুকুর দিনরাত পাহারা দেয়। অর্ফিয়ুসকে আসিতে দেখিয়া রাগে তাহার ছয় চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল— তাহার মুখ দিয়া বিষাক্ত আগুন ফেনাইয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু অর্ফিয়ুসের বীণার সুর যেমন তাহার কানে আসিয়া লাগিল, অমনি সে শান্ত হইয়া শুইয়া পড়িল। অর্ফিয়ুস অবাধে পাতালপুরীতে প্রবেশ করিলেন।
তখন পাতালপুরী কম্পিত করিয়া বীণার ঝঙ্কার বাজিয়া উঠিল। নরকের অন্ধকার ভেদ করিয়া সে সঙ্গীত পাতালের অতল গুহায় প্রবেশ করিল। সে শব্দে যমদূতের হুঙ্কার আর পাপীদের চিৎকার মুহূর্তের মধ্যে থামিয়া গেল। জলের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবিয়া অত্যাচারী ট্যান্টেলাস পিপাসায় পাগল,—পান করিতে গেলেই জল সরিয়া যায়! বীণার সঙ্গীতে সে তাহার তৃষ্ণা ভুলিয়া গেল। মহাপাপী ইক্সিয়ন নরকের ঘুরন্ত চক্রে ঘুরিতে ঘুরিতে এতদিন পরে বিশ্রাম পাইল, ঘুরন্ত চক্র স্তব্ধ হইয়া রহিল। ধূর্ত নিষ্ঠুর সিসিফাস্ চিরকাল ধরিয়া পাহাড়ের উপর পাথর গড়াইয়া তুলিতেছে, যতবার তোলে ততবার পাথর গড়াইয়া পড়ে; সেও দারুণ শ্রমের দুঃখ ভুলিয়া সেই সঙ্গীত শুনিতে লাগিল।
অর্ফিয়ুস যমরাজের সিংহাসনের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। যমরাজ প্লুটো ও রানী প্রসেরপিনা গম্ভীর হইয়া বসিয়া আছেন; তাঁহাদের পায়ের কাছে নিয়তিরা তিন বোনে জীবনের সূতা লইয়া খেলিতেছে। একজন সূতা টানিয়া ছাড়াইতেছে, একজন সেই সূতা পাকাইয়া জড়াইতেছে, আর একজন কাঁচি দিয়া পাকান সূতা ছাঁটিয়া ফেলিতেছে। অর্ফিয়ুসের সঙ্গীতে যমরাজ সন্তুষ্ট হইলেন, নিয়তিরা প্রসন্ন হইল। তখন আদেশ হইল, “ইউরিডিসকে ফিরাইয়া দাও, সে পৃথিবীতে ফিরিয়া যাক। কিন্তু সাবধান অর্ফিয়ুস! যমপুরীর সীমানা পার হইবার পূর্বে ইউরিডিসের দিকে ফিরিয়া চাহিও না—তবে কিন্তু সকলই পণ্ড হইবে।”
অর্ফিয়ুস মনের আনন্দে বীণা বাজাইয়া চলিলেন, তাঁহার পিছন পিছন ইউরিডিসও চলিলেন। যমপুরীর সীমানায় আসিয়া অর্ফিয়ুস মনের আনন্দে নিষেধের কথা ভুলিয়া ফিরিয়া তাকাইলেন। অমনি তাঁহার চোখের সম্মুখেই ইউরিডিসের অপূর্বসুন্দর মূর্তি বিদায়ের ম্লান হাসি হাসিয়া শূন্যের মধ্যে মিলাইয়া গেল।
তারপরে অর্ফিয়ুস আর কি করিবেন? তিনি বনে জঙ্গলে পাহাড়ে পাগলের মত সন্ধান করিতে লাগলেন। তাঁহার মনে হইল, বনের আড়ালে আড়ালে, পর্বতের গুহায় গুহায় ইউরিডিস লুকাইয়া আছেন। মনে হইল, গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের নিশ্বাস বলিতেছে, “ইউরিডিস, ইউরিডিস—” পাখিরা শাখায় শাখায় করুণ সুরে গান করিতেছে “ইউরিডিস, ইউরিডিস!”
এমনিভাবে অস্থিরমনে যখন তিনি ঘুরিতেছেন, তখন একদিন মদের দেবতা ব্যাকাসের সঙ্গীরা তাঁহাকে ধরিয়া বলিল, “তুমি স্ফূর্তি করিয়া বীণা বাজাও, আমরা নাচিব।” কিন্তু অর্ফিয়ুসের মনে সে স্ফূর্তি নাই, তাই বীণার তারেও কেবল দুঃখের সুরই বাজিতে লাগিল। তখন মাতালেরা রাগিয়া বলিল, “মার ইহাকে—এ আমাদের আমোদ মাটি করিতেছে।” তখন সকলে মিলিয়া অর্ফিয়ুস্কে মারিয়া তাহার দেহ নদীতে ভাসাইয়া দিল। সেই দেহ ইউরিডিসের নাম উচ্চারণ করিতে করিতে ভাসিয়া চলিল। শূন্যে অর্ফিয়ুসের আনন্দধ্বনি শুনিয়া সকলে বুঝিতে পারিল আবার তিনি ইউরিডিসকে ফিরিয়া পাইয়াছেন।
জলে স্থলে নদীর কলস্রোতে ঝরণার ঝর্ঝর শব্দে আনন্দ-কোলাহল বাজিয়া উঠিল।
অসিলক্ষণ পন্ডিত
রাজার সভায় মোটা মোটা মাইনেওয়ালা অনেকগুলি কর্মচারী। তাদের মধ্যে সকলেই যে খুব কাজের লোক, তা নয়। দ’চারজন খেটেখুটে কাজ করে আর বাকি সবাই বসে বসে মাইনে খায়।
যারা ফাঁকি দিয়ে রোজগার করে, তাদের মধ্যে একজন আছেন, তিনি অসিলক্ষণ পণ্ডিত। তিনি রাজার কাছে এসে বললেন, তিনি অসিলক্ষণ (আর্থাৎ তলোয়ারের দোষ-গুণ) বিচার করতে জানেন। অমনি রাজা বললেন, “উত্তম কথা, আপনি আমার সভায় থাকুন, আমার রাজ্যের যত তলোয়ার আপনি তার লক্ষণ বিচার করবেন।”
সেই অবধি ব্রাহ্মণ রাজার সভায় ভর্তি হয়েছেন, মোটারকম মাইনে পাচ্ছেন, আর প্রতিদিন তলোয়ার পরীক্ষা করছেন, আর বলছেন, “এই তলোয়ারটা ভালো, এই তলোয়ারটা খারাপ।” ভারই কঠিন কাজ! কত তলোয়ার ঘেঁটে-ঘুঁটে, দেখে আর শুঁকে, চটপট তার বিচার করেন।
তাঁর বিচারের নিয়মটি কিন্তু ভারি সহজ! তলোয়ার এনে যখন তাঁর হাতে দেওয়া হয়, তখন তিনি সেটাকে শুঁকে দেখেন। তলোয়ার যারা বানায়, তারা তলোয়ারের গায়ে তাদের মার্কা এঁকে দেয়। তাই দেখে বোঝা যায় কোনটা কার তলোয়ার। পণ্ডিতমহাশয় শুঁকবার সময় সেই মার্কাটুকু দেখে নেন। যাদের উপর তিনি খুব খুশি থাকেন, যারা তাঁকে পয়সা-টয়সা দেয়, আর খাইয়ে-দাইয়ে তোয়াজ করে, তাদের তলোয়ার দেখলেই তিনি নেড়েচেড়ে টিপেটুপে বলেন, “খাসা তলোয়ার! দিব্যি তলোয়ার! হাজার টাকা দামের তলোয়ার!” আর যাদের উপর তিনি চটা, যারা তাঁকে ঘুষও দেয় না, খাতিরও করে না, তাদের তলোয়ার যত ভালোই হোক না কেন, তাঁর কাছে পার পাবার যো নেই। সেগুলি জাতে পড়লেই তিনি অমনি একটু শুঁকেই নাক সিঁটকিয়ে বলে ওঠেন, “অতি বিচ্ছিরি! অতি বিচ্ছিরি! তলোয়ার তো নয়, যেন কাস্তে গড়েছে!”
এমনি ক’রে কত ভালো ভালো কারিকর, কত চমৎকার তলোয়ার বানিয়ে আনে, কিন্তু বিচারের গুণে তার দু-টাকাও দাম হয় না। এর মধ্যে একজন ওস্তাদ কারিকর আছে, সে বেচারা মনপ্রাণ দিয়ে একখানি তলোয়ার গড়ে, আর বিচারক মশাই, “দূর! দূর!” ক’রে সব বাতিল করে দেন। এই রকম হতে হতে শেষটা কারিকর গেল ক্ষেপে।
একদিন সে করল কি, একখানি তলোয়ার বানিয়ে, তার গায়ে বেশ ক’রে লঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে অসিলক্ষণ পণ্ডিতের কাছে এনে হাজির করল। পণ্ডিত নিতান্ত তাচ্ছিল্য ক’রে, “আবার কী গরে আনলি?” বলে, যেমনি তাতে নাক ঠেকিয়ে শুঁকতে গেছেন, অমনি লঙ্কার গুঁড়ো নাকে ঢুকতেই হ্যাঁ–চ্ –চো ক’রে এক বিকট হাঁচি, আর সেই সঙ্গে তলোয়ারের আগায় ঘ্যাঁচ ক’রে নাকে কেটে দু’খান!
চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল, “জল আনরে,” “কবিরাজ ডাকরে,”— ততক্ষণে তলোয়ারওয়ালা লম্বা লম্বা পা ফেলে তার বাড়ি পর্যন্ত পিঠ্টান দিয়েছে।
অসিলক্ষণ পণ্ডিতের মহা মুশকিল। একে তো কাটা নাকের যন্ত্রণা, তার উপর সভায় বেরুলে সবাই ক্ষ্যাপায়, “নাক-কাটা পণ্ডিত” ব’লে। বেচারার এখন মুখ দেখানই দায়, সে সভায়ও যেতে পারে না, চাকরিও করতে পারে না। তাকে দেখলেই লোক জিজ্ঞাসা করে, “তঁ লোঁ য়াঁ র টাঁ কেঁমন ছিঁলঁ !”
আজব সাজা
“পণ্ডিতমশাই, ভোলা আমায় ভ্যাংচাচ্ছে।”
“না পণ্ডিতমশাই, আমি কান চুলকাচ্ছিলাম, তাই মুখ বাঁকা দেখাচ্ছিল!”
পণ্ডিতমশাই চোখ না খুলিয়াই অত্যন্ত নিশ্চিন্ত ভাবে বলিলেন, “আঃ! কেবল বাঁদরামি! দাঁড়িয়ে থাক।” আধমিনিট পর্যন্ত সব চুপচাপ। তারপর আবার শোনা গেল, “দাঁড়াচ্ছিস না যে?”
“আমি দাঁড়াব কেন?”
“তোকেই তো দাঁড়াতে হবে।”
“যাঃ আমায় বলেছে না আর কিছু! গণশাকে জিগ্গেস কর? কিরে গণশা, ওকে দাঁড়াতে বলেছে না?” গণেশের বুদ্ধি কিছুটা মোটা, সে আস্তে আস্তে উঠিয়া গিয়া পণ্ডিতমশাইকে ডাকিতে লাগিল, “পণ্ডিতমশাই! ও পণ্ডিতমশাই!”
পণ্ডিতমশাই বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি বলছিস বল না।” গণেশচন্দ্র অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কাকে দাঁড়াতে বলেছেন, পণ্ডিতমশাই?” পণ্ডিতমশাই কট্মটে চোখ মেলিয়াই সাংঘাতিক ধমক দিয়া বলিলেন, “তোকে বলেছি, দাঁড়া।” বলিয়াই আবার চোখা বুজিলেন।
গণেশচন্দ্র দাঁড়াইয়া রহিল। আবার মিনিটখানেক সব চুপচাপ। হঠাৎ ভোলা বলিল, “ওকে এক পায়ে দাঁড়াতে বলেছিল না ভাই?” গণেশ বলিল, “কক্ষনো না, খালি দাঁড়াতে বলেছে।” বিশু বলিল, “এক আঙুল তুলে দেখিয়েছিল, তার মানেই এক পায়ে দাঁড়া।” পণ্ডিতমশাই যে ধমক দিবার সময় তর্জনী তুলিয়াছিলেন, এ কথা গণেশ অস্বীকার করিতে পারিল না। বিশু আর ভোলা জেদ করিতে লাগিল, “শিগগির এক পায়ে দাঁড়া বলছি, তা না হলে এক্ষুণি বলে দিচ্ছি।”
গণেশ বেচারা ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি এক পা তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অমনি ভোলা আর বিশুর মধ্যে তুমুল তর্ক বাঁধিয়া গেল। এ বলে ডান পায়ে দাঁড়ানো উচিত, ও বলে, না, আগে বাঁ পা। গণেশ বেচারার মহা মুশকিল! সে আবার পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞাসা করিতে গেল, “পণ্ডিতমশাই, কোন পা ?”
পণ্ডিতমশাই তখন কি যেন একটা স্বপ্ন দেখিয়া অবাক হইয়া নাক ডাকাইতেছিলেন। গণেশের ডাকে হঠাৎ তন্দ্রা ছুটিয়া যাওয়ায় তিনি সাংঘাতিক রকম বিষম খাইয়া ফেলিলেন। গণেশ বেচারা তার প্রশ্নের এ রকম জবাব একেবারেই কল্পনা করে নাই, সে ভয় পাইয়া বলিল, “ঐ যা কি হবে?” ভোলা বলিল, “দৌড়ে জল নিয়ে আয়।” বিশু বলিল, “শিগ্গির মাথায় জল দে।” গণেশ এক দৌড়ে কোথা হইতে একটা কুঁজা আনিয়া ঢক্ঢক্ করিয়া পণ্ডিতমশায়ের টাকের উপর জল ঢালিতে লাগিল। পণ্ডিতমশায়ের বিষম খাওয়া খুব চট্পট্ থামিয়া গেল, কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া গণেশের হাতে জলের কুঁজা ঠক্ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
ভয়ে সকলেই খুব গম্ভীর হইয়া রহিল, খালি শ্যামলাল বেচারার মুখটাই কেমন যেন আহ্লাদি গোছের হাসি হাসি মতো, সে কিছুতেই গম্ভীর হইতে পারিল না। পণ্ডিতমশায়ের রাগ হঠাৎ তার উপরেই ঠিক্রাইয়া পড়িল। তিনি বাঘের মতো গুমগুমে গলায় বলিলেন, “উঠে আয়!” শ্যামলাল ভয়ে কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল, “আমি কি করলাম? গণশা জল ঢাল্ল, তা আমার দোষ কি?” পণ্ডিতমশাই মানুষ ভালো, তিনি শ্যামলালকে ছাড়িয়া গণশার দিকে তাকাইয়া দেখেন তাহার হাতে তখনও জলের কুঁজা। গণেশ কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়াই বলিয়া ফেলিল, “ভোলা আমাকে বলেছিল।” ভোলা বলিল, “আমি তো খালি জল আনতে বলেছিলম। বিশু বলেছিল, মাথায় ঢেলে দে।” বিশু বলিল, “আমি কি পণ্ডিতমশায়ের মাথায় দিতে বলেছি? ওর নিজের মাথায় দেওয়া উচিত ছিল, তাহলে বুদ্ধিটা ঠাণ্ডা হত।”
পণ্ডিতমশাই খানিকক্ষণ কটমট করিয়া সকলের দিকে তাকাইয়া তারপর বলিলেন, “যা! তোরা ছেলেমানুষ তাই কিছু বললাম না। খবরদার আর অমন করিসনে।” সকলে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল, কিন্তু পণ্ডিতমশাই কেন যে হঠাৎ নরম হইয়া গেলেন কেহ তাহা বুঝিল না। পণ্ডিতমশায়ের মনে হঠাৎ যে তাঁর নিজের ছেলেবেলার কোন দুষ্টুমির কথা মনে পড়িয়া গেল, তাহা কেবল তিনিই জানেন।
আশ্চর্য কবিতা
চণ্ডীপুরের ইংরাজি স্কুলে আমাদের ক্লাশে একটি নূতন ছাত্র আসিয়াছে। তার বয়স বারো-চোদ্দোর বেশি নয়। সে স্কুলে আসিয়া প্রথম দিনই সকলকে জানাইল, “আমি পোইট্রি লিখতে পারি!” এ কথা শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল; কেবল দু-একজন হিংসা করিয়া বলিল, “আমরাও ছেলেবেলায় ঢের ঢের কবিতা লিখেছি।” নূতন ছাত্রটি বোধ হয় ভাবিয়াছিল, সে কবিতা লিখিতে পারে, শুনিয়া ক্লাশে খুব হুলুস্থল পড়িয়া যাইবে, এবং কবিতার নমুনা শুনিবার জন্য সকলে হাঁ হাঁ করিয়া উঠিবে। যখন সেরূপ কিছুরই লক্ষণ দেখা গেল না, তখন বেচারা, যেন আপন মনে কি কথা বলিতেছে, এরূপভাবে, যাত্রার মত সুর করিয়া একটা কবিতা আওড়াইতে লাগিল-