আপনাদের একটি হিরো সম্বন্ধে ইনফরমেশন চাই।
হিরো? মানস ব্যানার্জি?
অচিন্ত্য হালদার।
অচিন্ত্য হালদার? কই সে রকম নামে তো—ও হে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই নামে একটি ছেলে ঘোরাঘুরি করছে বটে। একটা বইয়ে একটা পার্টও করেছিল। চেহারা মোটামুটি ভাল, তবে ভয়েসে গণ্ডগোল। বরং সিনেমা লাইনে কিছু হতে পারে। আমি সেই কথাই বলেছি তাকে। ইন ফ্যাক্ট, ছেলেটি আমাকে টাকা অফার করেছে।
মানে? হিরোর পার্ট পাবার জন্য?
আপনি আকাশ থেকে পড়লেন যে! এ রকম হয় মিঃ মিত্তির।
আপনি আমল দেননি?
নো মিঃ মিত্তির। আমাদের নতুন কোম্পানি, এ সব ব্যাপার খুব রিস্কি! এ প্রস্তাবে রাজি হবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ইয়ে-চা, কফি,…?
নো, থ্যাঙ্কস।
আমরা উঠে পড়লাম। দেড়টা বাজে, পেটে বেশ চন্চনে খিদে। রয়েল হোটেলে খাবারের অড়ার দিয়ে ফেলুদা চন্দনা চুরির ব্যাপারে একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া করে ফেলল। ওর চেনা আছে। খবরের কাগজের আপিসে; সম্ভব হলে কালকে না। হয় লেটেস্ট পরশু কাগজে বেরিয়ে যাবে। গত দশ দিনের মধ্যে নিউ মার্কেটে তিনকড়িবাবুর দোকানো কেউ যদি একটা চন্দনা বিক্রি করে থাকেন, তা হলে তিনি যেন নিম্নলিখিত ঠিকানায়, ইত্যাদি।
বিরিয়ানি খেতে খেতে একটা নলী হাড় কামড় দিয়ে ভেঙে ম্যারো-টা মুখে পুরে ফেলুদা বলল, রহস্য যে রকম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান, দেখি গেস্ করতে পারি কি না, বললেন লালমোহনবাবু, এই নতুন রহস্য হচ্ছে–সেই লোক চিঠি নিয়ে আসবে বলে এল না কেন, এই তো?
ঠিক ধরেছেন। আমার মতে এর মানে একটাই। সে লোক চিঠিটা পাবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায়নি।
আমি বললাম, তার মানে যে চুরি করেছে সে নয়, অন্য লোক।
তাই তো মনে হচ্ছে।
ওরেব্বাস, বললেন লালমোহনবাবু, তার মানে তো একজন ক্রিমিন্যাল বাড়ল।
আচ্ছা ফেলুদা-এ প্রশ্নটা কি দিন থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে–পেপারওয়েট দিয়ে মাথায় মারলে লোক মরকেই এমন কোনও গ্যারান্টি আছে কি?
গুড কোয়েশেচনা, বলল ফেলুদা। উত্তর হচ্ছে, না নেই। তবে এ ক্ষেত্রে যে মেরেছে তার হয়তো ধারণা ছিল মরবোই।
কিংবা অজ্ঞান করে জিনিসটা নিতে চেয়েছিল; মারে যাবে ভাবেনি।
রয়েলের খাওয়া যে ব্রেন টনিকের কাজ করে, সেটা তো জানতাম না; তুই ঠিক বলেছিস তোপ্সে। সেটাও একটা পসিবল ব্যাপার। কিন্তু সেগুলো জানলেও যে এ ব্যাপারে খুব হেলপ হচ্ছে তা তো নয়। যে লোকটাকে দরকার সে এমন আশ্চর্য ভাবে গা ঢাকা দিয়েছে যে, ঘটনাটা প্ৰায় অসম্ভবের পযর্নয়ে পড়ে।
অবিশ্যি ভ্যানিশ যে করেনি। সে লোক সেটা সন্ধেবোলা জানতে পারলাম, আর সেটা ঘটল বেশ নাটকীয় ভাবে।
সেটা বলার আগে জানানো দরকার যে সাড়ে চারটের সময় হাজরা ফোন করে জানালেন। বারাসতে সাধন দস্তিদারের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
লালমোহনবাবু হোটেল থেকে আর বাড়ি ফেরেননি। আমাদের পীছে দিয়ে আমাদের এখানেই রয়ে গিয়েছিলেন। সাড়ে সাতটার সময় শ্ৰীনাথ আমাদের কফি এনে দিয়েছে, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। শীতকালের সন্ধে, পাড়াটা এর মধ্যেই নিঝুম, তাই বেলের শব্দে বেশ চমকে উঠেছিলাম।
দরজা খুলে আরও এক চমক।
এসেছেন হৃষীকেশবাবু।
কিছু মনে করবেন না-অসময়ে খবর না দিয়ে এসে পড়লাম-আমাদের টেলিফোনটা ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। মিঃ হালদারের মৃত্যুর পর থেকেই…
শ্ৰীনাথকে বলতে হয় না, সে নতুন লোকের গলা পেয়েই আরেক কাপ কফি দিয়ে গেল।
ফেলুদা বলল, আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বসে ঠাণ্ডা হয়ে কী ঘটনা বলুন। হৃষীকেশবাবু কফিতে একটা চুমুক দিয়ে দম নিয়ে বললেন, আপনি আমার একতলার ঘরটা দেখেননি, তবে আমি বলতে পারি ও ঘরটায় থাকতে বেশ সাহসের দরকার হয়। অত। বড় বাড়ির একতলায় আমি একমাত্র বাসিন্দা। চাকরীদের আলাদা কোয়ার্টারস আছে। এ ক বছরে অভ্যোস খানিকটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি হয় না। সন্ধে থেকে গাটা কেমন ছমছম করে। যাই হাক, কাল রাত্তিরে, তখন সাড়ে দশটা হবে, আমি খাওয়া সেরে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে মশারিটা ফেলেছি। সবে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। সত্যি বলতে কী, নক্ করার লোক ও বাড়িতে কেউ নেই। যারা আমাকে চায় তারা বাইরে থেকে হাঁক দেয়—এমন কী চাকর-বাকরিও। কাজেই বুঝতে পারছেন, আমার মনে বেশ একটু খটুকী লাগল। খোলার আগে জিজ্ঞেস করলুম, কে? উত্তরের বদলে আবার টাকা পড়ল। একবার ভাবলুম খুলব না। কিন্তু সারারাত যদি ওই ভাবে খট্খট্ চলে তা হলে তো আরও গণ্ডগোল। তাই কোনওরকমে সাহস সঞ্চয় করে যা থাকে কপালে করে দরজাটা খুললুম; খোলামাত্র একটি লোক ঢুকে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তখনও মুখ দেখিনি; তারপর আমার দিকে ফিরতে চাপ-দাড়ি দেখে আন্দাজ করলুম কে। ভদ্রলোক আমাকে কোনও কথা বলতে না দিয়ে সোজা গড়গড় করে তাঁর কথা বলে গেলেন এবং যতক্ষণ বললেন ততক্ষণ তাঁর ডান হাতে একটি ছোরা সোজা আমার দিয়ে পয়েন্ট করা।
বর্ণনা শুনে আমারই ভয় করছিল। লালমোহনবাবুর দেখলাম মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
কী বললেন সাধন দস্তিদার? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
সাংঘাতিক কথা, বললেন হৃষীকেশবাবু। মিঃ হালদারের কালেকশনে কী জিনিস আছে তা যেমন মোটামুটি আমি জানি, তেমনি ইনিও জানেন। বললেন বাহাদুর শা-র যে পান্না বসানো সোনার জন্দার কৌটোটা মিঃ হালদারের সংগ্রহে রয়েছে, সেটার একজন ভাল খদ্দের পাওয়া গেছে, সেটা তার চাই। আমি যেন আজ রাত্তিরে এগারেটার সময় মধুমুরলীর দিঘির ধারে ভাঙা নীলকুঠির পাশে শ্যাওড়া গাছটার নীচে ওয়েট করি—ও এসে নিয়ে যাবে।