আপনি পাৰ্ব্বতী হালদারকে চিনতেন বোধহয়?
মাই গড, এগেন?
ফেলুদা হাত তুলে ভদ্রলোককে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে বলল, আমি পুলিশের লোক নই সেটা আমার কার্ড দেখেই নিশ্চয় বুঝেছেন। তবে ঘটনাচক্রে আমি এই খুনের তদন্তে জড়িয়ে পড়েছি; আমি শুধু জানতে চাইছিলাম-এই যে নেপোলিয়নের চিঠিটা চুরি হয়েছে, সেটা সম্বন্ধে আপনার কী মত।
পেস্টনজী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি দেখেছি চিঠিটা?
ফেলুদা বলল, কী করে দেখব, যে দিন ভদ্রলোকের মৃত্যু, সে দিনেই তো আমি প্রথম গেলাম তার বাড়িতে।
পেস্টনজী বললেন, নেপোলিয়নের বিষয় পড়েছি তো তুমি?
তা কিছু পড়েছি।
ফেলুদা গত দু দিনে নেপোলিয়ন সম্বন্ধে আর পুরনো আর্টিস্টিক জিনিস সম্বন্ধে সিধু জ্যাঠার কাছ থেকে বেশ কিছু বই ধার করে এনে পড়েছে সেটা আমি জানি।
সেন্ট হেলেনায় তার শেষ নিবাসনের কথা জানো তো?
তা জানি।
কোন সালে সেটা হয়েছিল মনে আছে?
১৮১৫।
ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝলাম তিনি ইমপ্রেসড হয়েছেন। বললেন, এই চিঠি লেখা হয়েছিল ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে। সেন্ট হেলেনায় যে ছ। বছর বেঁচেছিলেন। নেপোলিয়ন, সেই সময়টা তাঁকে চিঠি লিখতে দেওয়া হয়নি। তার মানে এই চিঠিটা তাঁর শেষ চিঠিগুলির মধ্যে একটা। কাকে লেখা সেটা জানা যায়নি—শুধু মশেরামী–অর্থাৎ আমার প্রিয় বন্ধু। চিঠির ভাব ও ভাষা অপূর্ব। সব হারিয়েছেন তিনি, কিন্তু এই অবস্থাতেও তিনি এক বিন্দু আদর্শচ্যুত হননি। এ চিঠি লাখে এক। জুরিখ শহরে এক সর্বস্বান্ত মাতালের কাছ থেকে জলের দরে এ চিঠি কিনেছিলেন পাৰ্ব্বতী হালদার। আর সে জিনিস আমার হাতে চলে আসত মাত্র বিশ হাজার টাকায়।
কী রকম?–আমরা সকলেই অবাক-মাত্র বিশ হাজার টাকায় এ চিঠি আপনাকে বিক্রি করতে রাজি ছিলেন। মিঃ হালদার?
পেস্টনজী মাথা নাড়লেন। –নো নো। হি ডিড নট ওয়ন্ট টু সেল ইট। হালদারের গোঁ ছিল সাংঘাতিক। ওঁর এদিকটা আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম।
তা হলে?
পেস্টনজী গেলাসটা তুলে মুখে খানিকটা পানীয় ঢেলে বললেন, তোমাদের কিছু অফগর করতে পারি? চা, বিয়ার–?
না না, আমরা এখুনি উঠব।
ব্যাপারটা আর কিছুই না বললেন পেস্টনজী, এটা পুলিশকে বলিনি। ওদের জেরার ঠেলায় আমার ব্লাড প্ৰেশার চড়িয়ে দিয়েছিল সাংঘাতিকভাবে। ইউ লুক লাইক এ জেন্টলম্যান, তাই তোমাকে বলছি। কাল সকালে একটা বেনামি টেলিফোন আসে। লোকটা সরাসরি আমায় জিজ্ঞেস করে, আমি বিশ হাজার টাকায় নেপোলিয়নের চিঠিটা কিনতে রাজি আছি কি না। আমি তাকে গতকাল রাত্রে আসতে বলি। সে বলে সে নিজে আসবে না, লোক পাঠিয়ে দেবে, আমি যেন তার হাতে টাকাটা দিই। সে এও বলে যে, আমি যদি পুলিশে খবর দিই তা হলে আমারও দশা হবে পাৰ্ব্বতী হালদারের মতো।
এসেছিল সে লোক?—আমরা তিনজনেই যাকে বলে উদ্গ্ৰীব, উৎকর্ণ।
পেস্টনজী মাথা নাড়লেন। —নো। নোবাড়ি কেম।
আমরা তখনই উঠে পড়তাম, কিন্তু ফেলুদার হঠাৎ পেস্টনজীর পিছনের তাকের উপর রাখা একটা জিনিসের দিকে দৃষ্টি গেছে।
ওটা মিং যুগের পোর্সিলেন বলে মনে হচ্ছে?
ভদ্রলোকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত।
বাঃ, তুমি তো এ সব জানাটানা দেখছি। এক্সকুইজিট জিনিস।
একবার যদি…
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। হাতে নিয়ে না দেখলে বুঝতে পারবে না।
ভদ্রলোক উঠে গিয়ে জিনিসটার দিকে হাত বাড়িয়েই ‘আউচ!’ বলে যন্ত্রণায় কুঁচকে গেলেন।
কী হল? ফেলুদা গভীর উৎকণ্ঠার সুরে বলল।
আর বোলো না! বুড়ো বয়সের যত বিদঘুটে ব্যারাম। আরথ্রিইটিস। হাতটা কাঁধের উপর তুলতেই পারি না।
শেষকালে ফেলুদা নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাক থেকে চীনেমাটির পাত্রটা নামিয়ে নিয়ে হাতে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বার দু-এক সুপার্ব বলে আবার যথাস্থানে রেখে দিল।
ভদ্রলোকের সত্যিই হাত ওঠে কি না সেটা যাচাই করা দরকার ছিল, রাস্তায় এসে বলল ফেলুদা।
ধন্যি মশাই আপনার মস্তিষ্ক! বলুন, এবার কোনদিকে?
বলতে সংকোচ হচ্ছে। এবার একেবারে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট।
কেন, সংকোচের কী আছে?
যা দাম হয়েছে আজকাল পেট্রোলের।
আরে মশাই, দাম তো সব কিছুরই বেশি। আমার যে বই ছিল পাঁচ টাকা, সেটা এখন এইটি রুপিজ। অথচ সেল একেবারে স্টেডি। আপনি ওসব সংকোচ-টংকোচের কথা বলবেন না।
কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের নতুন থিয়েটার নবরঙ্গমঞ্চে গিয়ে হাজির হলাম। প্রোপ্ৰাইটারের নাম অভিলাষ পোদ্দার। ফেলুদা কার্ড পাঠাতেই তৎক্ষণাৎ আমাদের ডাক পড়ল। দোতলার আপিস ঘরে ঢুকলাম গিয়ে।
আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য আমার, স্বনামধন্য লোকের পায়ের ধুলো পড়ল। এই গরিবের ঘরে!
নাদুস-নুদুস বার্নিশ করা চেহারাটার সঙ্গে এই বাড়িয়ে কথা বলাটা বেশ মানানসই। হাতে সোনার ঘড়ি, ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল—এই সবে এক খিলি পান পুরেছেন মুখে, গা থেকে ভুরভুরে আতরের গন্ধ।
ফেলুদা লালমোহনবাবুকে আলাপ করিয়ে দিল গ্রেট থ্রিলার রাইটার বলে।
বটে? বললেন পোদ্দারমশাই।
একটা হিন্দি ফিল্ম হয়ে গেছে আমার গল্প থেকে, বললেন জটায়ু। বোম্বাইয়ের বোম্বেটে। নাটকও হয়েছে একটা গল্প থেকে। গড়পারের রিক্রিয়েশন ক্লাব করেছিল। সেভেনটি এইটে।
ফেলুদা বলল, আপনার জায়ান্ট অমনিবাস একটা পাঠিয়ে দেবেন না মিস্টার পোদ্দারকে।
সার্টেনলি, সার্টেনলি, বললেন মিঃ পোদার। আমি নিজে অবিশ্যি বই-টই পড়ি না, তবে আমার মাইনে করা লোক আছে। তারা পড়ে ও পিনিয়ন দেয়। আমাকে। তা বলুন মিঃ মিত্তির, আপনার কী কাজে লাগতে পারি।