এবারে ইনস্পেক্টর হাজরা এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। অচিন্ত্যবাবুর জেরা শেষ। তিনি গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাজরা বললেন, খুনটা হয়েছে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। পেস্টনজী ছিলেন সাড়ে নটা থেকে দশটার কিছু পর অবধি। সাধন দস্তিদার এসেছেন সেয়া দশটায়, গেছেন সাড়ে দশটায়। ছোট ছেলের ঘর থেকে বাইরের ঝরান্দা দিয়ে সোজা বাপের ঘরে যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরের লোক দেখতে পাবে না। দশটা পাঁচ থেকে সোয়া দশটার মধ্যে অচিন্ত্যবাবু বাপের ঘরে এসে থাকতে পারেন। উনি বলছেন। সারা সকাল পার্ট মুখস্থ করেছেন, কেবল সাড়ে দশটা নাগাদ একবার ভাইপো অনিরুদ্ধর ডাক পেয়ে তার কাছে যান। তার খেলার মেশিনগানটা দেখতে। তখনও তিনি বাপের মৃত্যু-সংবাদ পাননি। যাই হাক, মোটামুটি তিন জনেরই মোটিভ ছিল। ছেলের সঙ্গে বাপের বনত না, পেস্টনজী ছিলেন মিঃ হালদারের রাইভ্যাল, আর সাধন দস্তিদারের ছিল পুরনো আক্ৰোশ। এই হল ব্যাপার। এবার আপনি এসে একটু দেখে বলুন তো কিছু চুরি গেছে কি না।
শেষ অনুরোধটা করা হল হৃষীকেশবাবুকে। ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন স্টাডির দিকে, আমরা তাঁর পিছনে।
ঘরটায় ঢুকে স্বামীকেশবাবু একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। মেক্যানিক্যাল জিনিসে পাৰ্বতীবাবুর খুব শখ ছিল, কারণ বৈঠকখানায় দেখেছি। একটা প্রথম যুগের সিলিন্ডার গ্রামোফোন, আর এ ঘরে দেখছি একটা আদ্যিকালের ম্যাজিক ল্যানটার্ন। তা ছাড়া ছোট ছোট মূর্তি, পাত্র, দোয়াত, কলম, পিস্তল, পুরনো ছবি, ম্যাপ, বই-এ সব তো আছেই। বাইরের জিনিসপত্র দেখে, চাবি দিয়ে আলমারি, বাক্স দেরাজ ইত্যাদি খুলে দেখে অবশেষে হৃষীকেশবাবু জানালেন যে কোনও জিনিস গেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
ফেলুদা বলল, আপনি অ্যালক্যাথিনের খামটা একবার দেখলেন না?
ওতে তো চিঠিটা রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
তবু একবার দেখে নেওয়া উচিত।
হৃষীকেশবাবুকে খামটা খুলে ভেতরের কাগজটা টেনে বার করতে হল। কাগজের রংটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল; পুরনো কাগজ কি এত সাদা হয়? ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ফেলেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন।
এ কী! এঃ তো প্যাড থেকে ছেঁড়া হালদার মশাইয়ের নিজের চিঠির কাগজ।
অর্থাৎ নেপোলিয়নের চিঠি উধাও।
০৩. ফেলুদা বাড়ির কম্পাউন্ডটা ঘুরে দেখল
আরও আধা ঘণ্টা ছিলাম আমরা হালদারবাড়িতে। সেই সময়টা ফেলুদা বাড়ির কম্পাউন্ডটা ঘুরে দেখল। বাগানটা দেখা শেষ করে, কম্পাউন্ড ওয়ালের কোনও অংশ নিচু বা ভাঙা আছে কি না দেখে আমরা পুকুরের কাছে এলাম! ফেলুদার দৃষ্টি মাটির দিকে, জানি ও পায়ের ছাপ খুঁজছে। শুকনো মাটি, পায়ের ছাপের সম্ভাবনা কম, তবে পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটা অংশ ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সে থেমে গেল!
একটা ছোট্ট বুনো ফুলের গাছ যেন কীসের চাপে পিষে গেছে। আর সেটা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
ফেলুদা ফুলের আশপাশটা দেখে পুকুরের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এ পুকুর ব্যবহার হয় না, তাই জলটা পানার আবরণে ঢেকে গেছে। আমরা যেখানটা দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে হাত পাঁচেক দূরে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে পান সরে গিয়ে জল বেরিয়ে পড়েছে।
কিছু ফেলা হয়েছে কি জলের মধ্যে? তাই তো মনে হয়।
কিন্তু ফেলুদা এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। যা দেখবার ও দেখে নিয়েছে।
বাড়ি ফেরার সময় লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন, বাগানে একটা চন্দনা দেখলুম বলে মনে হল। একটা পেয়ারা গাছ থেকে উড়ে একটা সজনে গাছে গিয়ে বসল।
সেটা আমাদের বললেন না কেন? ধমকের সুরে বলল ফেলুদা।
কী জানি, যদি বেরিয়ে যায়। টিয়া! দুটো পাখি এত কাছাকাছি। তবে এ পাখিটা কথা বলে।
আপনি শুনলেন কথা?
শুনলুম বইকী। আপনারা তখন বাগানের উলটা দিকে; আমি আরেকটু হলেই একটা তেঁতুলে বিছের উপর পা ফেলেছি, এমন সময় শুনলুম, বাবু, সাবধান। আর মুখ তুলে দেখি পাখি।
পাখি বলল বাবু সাবধান?
তাই তো স্পষ্ট শুনলুম। আপনারা বিশ্বাস করবেন না বলেই বলিনি।
বিশ্বাস করাটা সত্যিই কঠিন, তাই কথা আর এগোল না।
তবে এটা ঠিক যে এ রকম একটা খুন। আর এ রকম চুরির পরেও ফেলুদার মন থেকে চন্দনার ব্যাপারটা যাচ্ছে না। খুনের দু দিন পর, সোমবার সকালে চা খাওয়ার পর ফেলুদার কথায় সেটা বুঝতে পারলাম, ও বলল, পার্বতীবাবুর খুন। আর নেপোলিয়নের চিঠি চুরি—এই দুটো ঘটনাই গতানুগতিক। কিন্তু আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে দিয়েছে এই পাখি চুরির ব্যাপারটা।
গতকাল অমিতাভ বাবু ফোন করেছিলেন; ফেলুদা জানিয়ে দিয়েছে যে নেহাত দরকার না। পড়লে এই অবস্থায় ও আর ওঁদের বিরক্ত করবে না, বিশেষ করে পুলিশ যখন তদন্ত চালাচ্ছেই। লালমোহনবাবু বলেছেন সোমবার হলেও আজ একবার আসবেন, কারণ কী ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না হচ্ছে সেটা জানার ওঁর বিশেষ আগ্ৰহ।
আমি বললাম,পাখির খাঁচার গায়ে রক্তটা পাখির না মানুষের সেটা তো এখনও জানা গেল না।
ওটা যে মানুষের, সেটা অ্যানালিসিস না করেই বলা যায়, বলল ফেলুদা।কেউ যদি পাখিকে খাঁচা থেকে বার করতে যায় তা হলে সেটা সাবধানেই করবে, কিন্তু পাখি ছটফট করতে পারে, খামচাতে পারে, ঠোকুরাতে পারে। অর্থাৎ যে লোকে পাখিটাকে কার করেছে, তার হাতে জখমের চিহ্ন থাকা উচিত।
সে জিনিস ও বাড়ির কারুর হাতে দেখলে?