আমি তো সেটাই দেখতে এলাম।
খাঁচাটা একটা হুক থেকে ঝুলছে বারান্দায় রেলিং-এর উপরে। ঝকঝকে ভাবটা দেখে বোঝা যায় খাঁচটাও কেনা হয়েছিল পাখির সঙ্গেই। ফেলুদা সেটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা এখনও খোলাই রয়েছে।
আপনার বাড়ির কোনও চাকরের পাখিতে অ্যালার্জি আছে বলে জানেন?
অমিতাভ বাবু হেসে উঠলেন।
সেটা ভাববার তো কোনও কারণ দেখি না। আমাদের বাড়ির কোনও চাকরাই কুড়ি বছরের কম পুরনো নয়। তা ছাড়া এক কালে এ বাড়িতে একসঙ্গে দুটো গ্রে প্যারটি ছিল। বাবা নিজেই এনেছিলেন। অনেক দিন ছিল তারপর মারা যায়।
এই ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন কি?
ফেলুদা বেশ কিছুক্ষণ হাত দিয়ে খাঁচাটাকে নেড়ে-চেড়ে প্রশ্নটি করল।
অমিতাভবাবুর সঙ্গে আমরা দুজনও এগিয়ে গেলাম।
ফেলুদা খাঁচার দরজাটার একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।
ছোট্ট একটা লালের ছোপ বলে মনে হচ্ছে? বললেন অমিতাভবাবু। তার মানে কি–?
যা ভাবছেন তাই। ব্লাড।
চন্দনা মার্ডার? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা খাঁচার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, পাখির রক্ত না মানুষের রক্ত সেটা কেমিক্যাল অ্যানালিসিস না করে বোঝা যাবে না। তবে একটা স্ট্রাগল হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অবিশ্যি সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা বোঝাই যাচ্ছে যে খাঁচার দরজা খোলা রাখার জন্য পাখি পালায়নি; দরজা খুলে পাখিকে বার করে নেওয়া হয়েছে। আপনারা কেথেকে কিনেছিলেন পাখিটা?
নিউ মার্কেট, বলে উঠল। অনিরুদ্ধ।
অমিতাভবাবু বললেন, ‘নিউ মার্কেটের তিনকড়িবাবুর পাখির দোকান খুব পুরনো দোকান। আমাদের জানাশোনা অনেকেই ওখান থেকে পাখি কিনেছে।
অনিরুদ্ধর ইচ্ছা ছিল তার নতুন কেনা খেলনাগুলো আমাদের দেখায়, বিশেষ করে মেশিনগানটা, কিন্তু অমিতাভবাবু বললেন, এঁরা আবার তোমার কাছে আসবেন। তখন তোমার খেলনা দেখবেন, তোমার মা-র সঙ্গে আলাপ করবেন, চা খাবেন—সব হবে। আগে দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, কেমন?
আমরা পার্বতীবাবুর স্টাডির উদ্দেশে রওনা দিলাম।
কিন্তু দাদুর সঙ্গে আর আলাপ হল না। লালমোহনবাবু পরে বলেছিলেন, এক-একটা ঘটনার শক-এর এফেক্ট নাকি সারা জীবন থাকে। এটা সেইরকম একটা ঘটনা।
বৈঠকখানায় ঢুকেই বুঝেছিলাম চারিদিকে দেখবার জিনিস গিজগিজ করছে। সে সব দেখার সময় ঢের আছে মনে করে আমরা এগিয়ে গেলাম। ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পর্যাদা দেওয়া সন্টাডির দরজার দিকে।
আসুন বলে অমিতাভবাবু গিয়ে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। আর ঢোকামাত্র এক অস্ফুট চিৎকার দিয়ে উঠলেন—
বাবা।
ফেলুদার অমিতাভবাবুকে দু হাত দিয়ে ধরতে হল, কারণ ভদ্রলোক প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন।
ততক্ষণে আমরা দুজনেও ঘরে ঢুকেছি।
বিরাট মেহগনি টেবিলের পিছনে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। পার্বতীচরণ হালদার। তাঁর মাথাটা চিত, দুটো পাথরের মতো চোখ চেয়ে আছে সিলিং-এর দিকে, হাত দুটো ঝুলে রয়েছে চেয়ারের দুটো হাতলের পাশে।
ফেলুদা এক দৌড়ে চলে গেছে ভদ্রলোকের পাশে। নাভীটা দেখার জন্য হাতটা বাড়িয়ে আমাদের দিকে ফিরে বলল, তোরা দৌড়ে গিয়ে ওই সাধন লোকটাকে আটকা.দারোয়ানকে বল। দরকার হলে বাইরে রাস্তায় দ্যাখ—
আমার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুও ছুটি দিলেন। মন বলছিল, দশ মিনিট চলে গেছে, সে লোককে আর পাওয়া যাবে না—বিশেষ করে যদি সে খুন করে থাকে।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় কোলিশন হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম। উনি পার্বতীচরণের বর্তমান সেক্রেটারি হৃষীকেশবাবু। দুজন অচেনা লোককে এইভাবে তড়িঘড়ি নামতে দেখে তিনি কী ভাবলেন সেটা আর তখন ভাবার সময় ছিল না।
বাইরে কেউ নেই, রাস্তায়ও না, কারুর থাকার কথাও নয়। যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল সেটা হল এই যে দারোয়ান জোর গলায় বলল, গত দশ মিনিটের মধ্যে কেউ গেট দিয়ে বাইরে যায়নি। বাবুর কাছে লোক আসবে বলে সে সকাল থেকে ডিউটিতে রয়েছে, তার ভুল হতেই পারে না।
চলো বাগানের দিকটা দেখি, বললেন লালমোহনবাবু, হয়তো কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।
তাই করলাম। দক্ষিণের পুকুরের ধার, পশ্চিমের গোলাপ বাগান, কম্পাউন্ড ওয়ালের পাশটা, চাকরীদের ঘরের আশেপাশে, কোথাও বাদ দিলাম না। পাঁচিল টপকানোও সহজ নয়, কারণ প্রায় আট ফুট উঁচু।
হাল ছাড়তে হল।
সাধনবাবু উধাও।
০২. মৃত্যুটা হয়েছে মারার সঙ্গে সঙ্গেই
পার্বতীবাবুকে মাথার উপরের একটা ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত মেরে খুন করা হয়েছে। এঁদের বাড়ির ডাক্তার সৌরীন সোম বললেন, মৃত্যুটা হয়েছে মারার সঙ্গে সঙ্গেই। ভদ্রলোকের রক্তের চাপ ওঠা-নামা করত, হার্টেরও গোলমাল ছিল।
ইতিমধ্যে পুলিশও এসে গেছে। ইন্সপেক্টর হাজরা ফেলুদাকে চেনেন। মোটামুটি খাতিরও করেন। সাধারণ পুলিশের লোক প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরকে যে রকম অবজ্ঞার চোখে দেখে, সে রকম নয়। বললেন, আমাদের যা রুটিন কাজ তা করে যাচ্ছি। আমরা, যদি কিছু তথ্য বেরোয় তো আপনাকে জানাব।
ফেলুদা বলল, যে ভারী জিনিসটা দিয়ে খুন করা হয়েছিল সেটা সম্বন্ধে কোনও আইডিয়া করেছেন?
হাজরা বললেন, তেমন তো কিছু দেখছি না। আশেপাশে। খুনি সেই জিনিসটা নিয়েই ভৌগেছে বলে মনে হচ্ছে।
পেপারওয়েট।
পেপারাওয়েট?
একবার আসুন আমার সঙ্গে।
হাজরা ও ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও ঢুকলাম ঘরের মধ্যে।
ফেলুদা টেবিলের একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।