কারণ সোয়া দশটার সময় আপনারও তো পাৰ্বতীচরণের ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়ে থাকতে পারে!
এ সব কী বলছেন। আপনি? আপনি নিজেই বলছেন। সাধনবাবুকে বেরোতে দেখেছেন, আবার বলছেন আমি গিয়েছি?
ধরুন সাধন দস্তিদার যদি নাই এসে থাকেন। তার জায়গায় আপনি গেলেন।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘরে সবাই চুপ, তারই মধ্যে হৃষীকেশবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন।
মিঃ হালদার কি উন্মাদ না জরাগ্রস্ত, যে আমি দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকব আর তিনি আমাকে চিনবেন না?
কী করে চিনবেন, হৃষীকেশবাবু? আপনি যদি গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে চোখের চশমাটা খুলে পোশাক বদলে তাঁর ঘরে ঢোকেন, তা হলে আপনাকে সাত বছর আগের সাধন দস্তিদার বলে। কেন মনে করবেন না পাৰ্বতীবাবু? আপনি আর সাধন দস্তিদার যে আসলে একই লোক! প্রতিশোধ নেবার জন্য চেহারা পালটে নাম পালটে সেই একই লোক যে আবার সেক্রেটারি হয়ে ফিরে এসেছে, সেটা তো আর বোঝেননি পার্বতীচরণ!
হৃষীকেশবাবুর মুখের ভাব একদম পালটে গেছে। তাঁর ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। দুজন কনস্টেবল এগিয়ে গেল তাঁর দিকে!
ফেলুদার কথা এখনও শেষ হয়নি।
খুনের পর কি আপনার ভাড়া করা কোটের পকেটে পেপার ওয়েট পুরে তার ওজন বাড়িয়ে আপনি পুকুরের জলে ফেলে দেননি? তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আবার হৃষীকেশ দত্ত সেজে বেরিয়ে আসেননি?
এই শীতকালেও হৃষীকেশবাবুর শার্টের কলার ভিজে গেছে।
আরও একটা কথা, বলে চলল ফেলুদা। সাধু সাবধান কথাটা কি চেনা চেনা লাগছে? অনিরুদ্ধের জন্য কেনা চন্দনার মুখে কি কথাটা শোনেননি। আপনি সম্প্রতি? আর শুনে আপনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে কি বিশ্বাস ঢোকেনি যে কথাটা আপনাকে উদ্দেশ করেই বলছে? আপনি সাধু সেজে মনিবের সর্বনাশ করতে যাচ্ছেন জেনেই পাখি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছে? আপনিই কি এই পাখিকে খাঁচা থেকে বার করে বাগানে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেননি? এবং এই কাজটা করার সময় আপনাকেই কি পাখি জখম করেনি?
হৃষীকেশবাবু এবার লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার থেকে।
অ্যাবসার্ড! অ্যাবসার্তা! কোথায় জখম করেছে? কোথায়?
ইনস্পেক্টর হাজরা, আপনার লোককে বলুন তো ওঁর ডান হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নিতে।
প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও ঘড়ি খুলে এল।
কবজিতে প্ৰায় এক ইঞ্চি লম্বা একটা আঁচড়ের দাগ, সেটা দিব্যি ঘড়ির ব্যান্ডের তলায় লুকিয়ে ছিল।
আমি খুন করতে যাইনি–দোহাই আপনার–বিশ্বাস করুন!
হৃষীকেশবাবুর অবস্থা শোচনীয়।
সেটা অবিশ্বাস্য নয়, বলল ফেলুদা, কারণ আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল নেপোলিয়নের চিঠিটা নেওয়া। পেস্টনজী বড় রকম দর দিয়েছেন সেটা আপনি জানতেন। মিঃ হালদার বেচাবেন না সেটাও আপনি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন। কিন্তু জিনিসটা চুরি করে তো পেস্টনজীর কাছে বিক্রি করা যায়! তাই—
আমি না, আমি না? মরিয়া হয়ে প্রতিবাদ জানালেন হৃষীকেশবাবু।
আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। ফেলুমিত্তির আধাখেচড়াভাবে সমস্যার সমাধান করে না। এ ব্যাপারে আপনি এক নন, সেটা আমি জানি। চিঠিটা বার করে এনে নিজের ঘরে গিয়ে মেক-আপ বদলে আপনি যান আরেকজনের কাছে চিঠিটা দিতে। কিন্তু বাড়িতে খুন হয়েছে, খানাতল্লাশি হবে, সেটা জেনে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও সাময়িকভাবে চিঠিটাকে অন্য জায়গায় চালান দেন। তাই নয়, অচিন্ত্যবাবু?
প্রশ্নটা একেবারে বুলেটের মতো। কিন্তু লোকটার আশ্চর্য নাৰ্ভ। অচিন্তবাবু ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দিব্যি বসে আছেন সোফায়।
বলুন, বলুন, কী বলবেন, বললেন ভদ্রলোক, আপনি তো দেখছি সবই জেনে বসে আছেন।
আপনি সাড়ে দশটার একটু পরে একবার আপনার ভাইপোর ঘরে যাননি?
গিয়েছিলাম বইকী। আমার ভাইপোর ঘরে যাওয়ায় তো কোনও বাধা নেই। সে ক’দিন থেকেই বলছে তার নতুন খেলনা দেখাবে, তাই গিয়েছিলাম।
আপনার ভাইপোর ঘরে গতকাল এবং তার আগের রাত্রে একজন চোর ঢুকেছিল। সে যা খুঁজছিল তা পায়নি। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে, সে চার আপনিই এবং আপনি খুঁজতে গিয়েছিলেন নেপোলিয়নের চিঠি-যেটা আপনিই তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন? চিঠিটা পাবেন। এই বিশ্বাসে আপনিই পেস্টনজীকে ফোন করে আফার দিয়েছিলেন, তারপর সেটা না পেয়ে আর পেস্টনজীর ওখানে যেতে পারেননি?
আমিই যখন লুকিয়েছিলাম, তখন সেটা আমি কেন পাব না সেটা বলতে পারেন?
কারণ যাতে লুকিয়েছিলেন, সেটা ছিল খোকার বালিশের তলায়। এই যে।
ফেলুদা মিঃ হাজরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হবি সেন্টার থেকে কেনা লাল প্লাস্টিকের মেশিনগান চলে এল ফেলুদার হাতে। তার নলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিতে বেরিয়ে এল গোল করে পাকানো নেপোলিয়নের চিঠি।
হৃষীকেশবাবুর মেক-আপের ব্যাপারে আপনিই মালমশলা সাপ্লাই করেছিলেন বোধহয়? প্রশ্ন করল ফেলুদা,ভাগ বাঁটায়ারা কী রকম হত? ফিফ্টি ফিফ্টি?
*
মালীর ছেলে শঙ্কর চন্দনাটা ধরতে পেরেছিল ঠিকই, যদিও পাখি ফেরত পাওয়ার পুরো ক্রেডিটটা তার খুদে মক্কেলের কাছে ফেলুদাই পেল।
অমিতাভবাবু ফেলুদাকে অফার করেছিলেন পাৰ্বতীচরণের কালেকশন থেকে একটা কোনও জিনিস বেছে নিতে। ফেলুদ রাজি হল না। বলল, এই কেসটায় আমার জড়িয়ে পড়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। আসলে আমি এসেছিলাম। আপনার ছেলের ডাকে। তার কাছ থেকে তো আর ফি নেওয়া যায় না?
ঘটনার দু দিন পরে শনিবার সকালে লালমোহনবাবু এসে বললেন, জলের তল পাওয়া যায়, মনের তল পাওয়া দায়। আপনার অতলস্পর্শী চিন্তাশক্তির জন্য আপনাকে একটি অনারারি টাইটেলে ভূষিত করা গেল। —এ বি সি ডি।