ওরা গুণ্ডা ছিল বুঝি? হায়ার্ড গুণ্ডাজ, বললেন লালমোহনবাবু।
বললাম লোকটা ডেঞ্জারাস, বললেন হৃষীকেশবাবু। তবে ও যে এতটা করবে তা ভাবিনি। আমি তো গিয়ে অবাক। একজন শোয়া একজন বসা একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। আর আসল যে লোক সে হাওয়া।
ফেলুদা আর লালমোহনবাবু নাকি আমাকে ধরাধরি করে গাড়িতে এনে তোলেন। অমিতাভবাবু নিজে বেশ রাত অবধি পড়েন, তাই উনি জেগে ছিলেন। যে ঘরটায় আমরা রয়েছি সেটা একতলার একটা গেস্ট রুম। বেশ বড় ঘর, পাশেই বাথরুম। পুবে জানালা দিয়ে নাকি বাগান দেখা যায়। অমিতাভবাবুই জোর করলেন আজ রাতটা এখানে থাকার জন্য। অসুবিধা এই যে বাড়তি কাপড় নেই, যা পরে আছি তাই পরেই শুতে হবে। হৃষীকেশবাবুর ভয়ের জন্যই এই গোলমালটা হল, বললেন অমিতাভবাবু, পুলিশকে বলা থাকলে সাধু সমেত গুণ্ডারা এতক্ষণে হাজতে।
হৃষীকেশবাবুও অবিশ্যি অ্যাপলজাইজ করলেন। কিন্তু ভদ্রলোককেই বা দোষ দেওয়া যায় কী করে? ও রকম শাসনির পর যে কোনও মানুষেরই ভয় হতে পারে।
অমিতাভবাবুর স্ত্রীই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বললেন, বাড়িতে এই দুর্যোগ, আপনাদের সঙ্গে বসে দু দণ্ড কথা বলারও সুযোগ হল না। এনার এত বই আমি পড়েছি।–কী যে আনন্দ পাই তা বলতে পারি না।
শেষের কথাটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ করে বলা।
ফেলুদা বলল, কাল সকালে যাবার আগে আপনার ছেলের সঙ্গে একবার কথা বলে নেব। ঘরে চোর ঢোকার পরেও ও যা সাহস দেখিয়েছে তেমন সচরাচর দেখা যায় না।
সাড়ে বারোটা নাগাদ যখন আমরা শোবার আয়োজন করছি তখন ফেলুদা একটা কথা বলল।
ঘুঁষিটাও যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটা আজ প্রথম জানলাম।
কী রকম? বললেন লালমোহনবাবু।
সাধুবাবু ভ্যানিশ করার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি এতদিনে।
বলেন কী!
তুখোড় লোক। তবে যার সঙ্গে মোকাবিলা করছে, সেও তো কম তুখোড় নয়।
এর বেশি আর কিছু বলল না ফেলুদা।
০৬. এ বি সি ডি – এশিয়া’জ বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর
অনিরুদ্ধ সকালে স্কুলে যায়, তাই চা খাবার আগেই ফেলুদা ওর সঙ্গে দেখা করে নিল।
চোর ঢোকারর কথাটা আজ শুনে মনে হল ছেলেটি বেশি রকম কল্পনাপ্রবণ; পরপর দুবার; একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হল। ফেলুদা বলল, তুমি যে বন্দুকটা দিয়ে চোরকে মারবে ঠিক করেছিলে সেটা তো আমাকে দেখালে না। শুনলাম তোমার ছোটকাকাকে দেখিয়েছ।
অনিরুদ্ধ বন্দুকটা বার করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বলল, এটা থেকে আগুনের ফুলকি বেরোয়।
লাল প্লাস্টিকের তৈরি মেশিনগান, ট্রিগার টিপলে মেশিনগানের মতো শব্দের সঙ্গে নলের মুখ দিয়ে সত্যিই স্পার্ক বেরোয়।
ফেলুদা বন্দুকটা নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে সেটার খুব তারিফ করে ফেরত দিয়ে বলল, তোমার যে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে, দেখা যাক সেটা বন্ধ করা যায় কি না।
তুমি চোর ধরে দেবে?
গোয়েন্দার তো ওই কাজ।
আর আমার চন্দনা যে চুরি করেছে সেই চোর?
সেটারও চেষ্টা চলেছে, তবে কাজটা খুব সহজ নয়।
খুব শক্ত?
খুব শক্ত।
দারুণ রহস্য?
দারুণ রহস্য।
আর সে দিন যে বললে, খাঁচার দরজায় রক্ত লেগে আছে?
ওটাই তো ভরসা। ওটাই তো ক্লু।
ক্লু মানে?
কু হল যার সাহায্যে গোয়েন্দা দুষ্ট লোককে জব্দ করে।
লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমার পাখিকে কথা বলতে শুনেছ?
হ্যাঁ, বলল অনিরুদ্ধ। আমি ঘরে ছিলাম, আর শুনলাম পাখিটা কথা বলছে।
কী কথা?
বলছে : দাদু ভাত খান, দাদু ভাত খান। আমি তক্ষুনি বেরিয়ে এলাম। কিন্তু তারপর আর কিছু বলল না।
লালমোহনবাবুর মুখে হাসি। অনিরুদ্ধ শুনেছে, দাদু ভাত খান আর লালমোহনবাবু শুনেছেন, বাবু সাবধান! মানতেই হয় দুটো খুব কাছাকাছি। পাখি নিশ্চয়ই ওই ধরনেরই কিছু বলছিল।
আপনার এখানে পাখি ধরতে পারে এমন কেউ আছে? ফেলুদা অমিতাভবাবুকে জিজ্ঞেস করল।
আমাদের মালীর ছেলে আছে, শঙ্কর, বললেন অমিতাভবাবু। এর আগে দু-একবার ধরেছে পাখি। খুব চালাক-চতুর ছেলে।
তাকে বলবেন একটু চোখ রাখতে। খুব সম্ভব চন্দনািট আপনাদের বাগানেই রয়েছে।
বারাসতে থাকতেই দেখেছিলাম যে, খবরের কাগজে চন্দনার বিষয় বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে। সেটার কাজ ষে এত তাড়াতাডি হবে তা ভাবতে পারিনি।
বারোটা নাগাদ একটি বছর পাঁচিশের ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বেশ চোখাচোখা চেহারা, পরনে জিনস আর মাথার চুলের কপাল-ঢাকা কায়দা দেখলেই বোঝা যায় ইনি হাল-ফ্যাশানের তরুন।
ফেলুদা বসতে বলতে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, বাসব না। আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। ইয়ে, আমি আসছি। ওই পাখির ব্যাপারে কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছেন সেইটে দেখে।
ওটা আপনাদের পাখি ছিল?
আমাদের মানে আমার দাদুর। দাদু মারা গেছেন। লাস্ট মানুথ। তাই বাবা ওটাকে বেচে দিলেন। ওটার দেখাশুনা দাদুই করতেন। বাবা কোর্ট-কাচারি করেন, মা বাতে ভোগেন, আর আমার ও সবে ইন্টারেস্ট নেই।
কদ্দিন ছিল আপনাদের বাড়ি?
তা বছর দশেক। দাদুর খুব পিয়ারের চন্দনা ছিল।
কথা বলত?
হ্যাঁ। দাদুই শিখিয়েছিলেন। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শিখিয়েছিলেন।
অদ্ভুত মানে?
এই যেমন—দাদুর পাশার নেশা ছিল; পাখিটাকে শিখিয়েছিলেন ‘কচে বারো’ বলতে। তারপর ব্রিজও খেলতেন দাদু। খেলার সময় অপোনেন্টের তাস ভাল বুঝতে পারলে পার্টনারকে একটা কথা খুব বলতেন। সেটা পাখিটা তুলে নিয়েছিল।