ওই যে দেখুন। শ্যাওড়া গাছ, বললেন হৃষীকেশবাবু! ফেলুদা সে দিকে একবার টর্চ ফেলে সেটা নিবিয়ে পকেটে পুরল।
আমি তা হলে আসি।
আসুন।
তিন কোয়াটার আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা যে দিক দিয়ে এসেছিলাম। সে দিক দিয়েই চলে গেলেন হৃষীকেশবাবু; এক মিনিটের মধ্যেই তাঁর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল।
ওডোমাসটা লাগিয়ে নিন।
ফেলুদা পকেট থেকে টিউব বার করে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
যা বলেছেন মশাই। ম্যালেরিয়া শুনছি। আবার খুব বেড়েছে।
আমরা তিন জনেই ওডোমস লাগিয়ে নিয়ে একটা বড় রকম দম নিয়ে অপেক্ষার জন্য তৈরি হলাম। আমাদের কাউকেই দাঁড়াতে হবে না, কারণ ভগ্নস্তূপে নানান হাইটের ইটের পাঁজা রয়েছে, তাতে চেয়ার চৌকি মোড়া সব কিছুবই কাজ হয়? কথা বলতে হলে ফিসফিস্ ছাড়া গতি নেই, তাও প্রথম দিকটায়। পরের দিকে কমপ্লিট মীনী। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে, এখন চারিদিকে চাইলে বট, অশ্বথ, আমগাছ, বাঁশঝাড়—এসব বেশ তফাত করা যায়। ঝিঝির শব্দ ছাড়াও যে অন্য শব্দ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। ট্রেনের আওয়াজ, সাইকেল রিকশার চড়া হর্ন, রাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ, এমন কী দূরের কোনও বাড়ি থেকে ট্রানজিস্টারের গান পর্যন্ত। ফেলুদার ঘড়িতে রেডিয়াম ডায়াল, তাই অন্ধকারেও টাইম দেখতে পারে।
শীত যেন মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। শহরের চেয়ে নিঘাত পাঁচ-সাত ডিগ্রি কম। লালমোহনবাবু তাঁর টুপি আনেননি, রুমাল সাদা, তাই সেটা বাঁধলেও চলে না; নিরুপায় হয়ে দুহাতের তেলো দিয়ে টাক ঢেকেছেন। একবার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করাতে ফেলুদা বলল, কিছু বললেন? তাতে ভদ্রলোক ফিসফিস করে জবাব দিলেন, শ্যাওড়া গাছেই বোধহয় পেত্ত্বি না। শাঁকচুন্নি কী যেন থাকে।
শ্যাওড়া গাছের নামই শুনেছি, ফিসফিসিয়ে বলল ফেলুদা, চোখে এই প্রথম দেখলাম।
আকাশে তারাগুলো সরছে। একটু আগে একটা তারাকে দেখেছিলাম নারকেল গাছের মাথার উপরে, এখন দেখছি গাছটায় ঢাকা পড়ে গেছে। কোনও চেনা কনস্টেলেশন আছে। কি না দেখার জন্য মাথাটা উপর দিকে তুলেছি, এমন সময় একটা শব্দ কানে এল। পায়ের শব্দ।
এগারোটা বাজেনি এখনও। ফেলুদা দু মিনিট আগে ঘড়ি দেখে ফিসফিস করে বলেছে, পৌনে।
আমরা পাথরের মতো স্থির।
যে দিক দিয়ে এসেছি, সে দিক দিয়েই আসছে শব্দটা। ঘাসের উপর মাঝে মাঝে ইট-পাটকেল রয়েছে, তার জন্যই শব্দ। তাও কান না পাতালে, আর অন্য শব্দ না কমলে শোনা যায় না। এখন বিপ্নবিষ্ণুর ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
এবার লোকটাকে দেখা গেল। সে এগিয়ে এসেছে শ্যাওড়া গাছটাকে লক্ষ্য করে।
এবারে তার হাঁটার গতি কমল। আমরা মাটিতে ঘাপটি মেরে বসা, সামনে একটা ভাঙা পাঁচিল আমাদের শরীরের নীচের অংশটা ঢ়েকে রেখেছে। আমরা তার উপর দিয়ে দেখছি।
হৃষীকেশবাবু—
লোকটা চাপা গলায় ডাক দিয়েছে। হাঁটা থামিয়ে। তাঁর দৃষ্টি যে শ্যাওড়া গাছটার দিকে সেটা মাথাটা দেখে আন্দাজ করতে পারছি, যদিও মানুষ চেনার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।
হৃষীকেশবাবু—
ফেলুদা ওঠার জন্য তৈরি। তার শরীর টান সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
লালমোহনবাবুর ডান কনুইটা উচিয়ে উঠেছে। উনি পকেট হাতড়াচ্ছেন হামানদিস্তার ভাণ্ডাটার জন্য।
লোকটা এখন দশ হাতের মধ্যে।
হৃষীকেশ—
ফেলুদা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠতেই একটা রক্ত জল করা ব্যাপার ঘটে গেল।
আমাদের পিছন থেকে দুটো লোক এসে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
ফেলুদার সঙ্গে থেকেই বোধহয় আমার নার্ভ ও শক্ত হয়ে গেছে। চট করে বিপদে মাথা গুলোয় না। আমি তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামনের দিকে! ফেলুদার ঘুঁষি খেয়ে একটা লোক আমারই দিকে ছিটকে এসেছিল। আমি তাকে লক্ষ্য করে আরেকটা ঘুঁষি
চালাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘাসের উপর।
কিন্তু এ কী, আরও লোক এসে পড়েছে। পিছন থেকে! তার মধ্যে একটা আমায় জাপটে ধরেছে, আরও দুটো গিয়ে আক্রমণ করেছে ফেলুদাকে। ধস্তাধস্তির শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু আমি নিজে বন্দি, যদিও তারই মধ্যে জুতো পরা ডান পা-টা দিয়ে ক্ৰমাগত পিছন দিকে লাথি চালাচ্ছি।
লালমোহনবাবু কী করছেন এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই থুতনিতে একটা বিরাশি শিক্কা ঘা খেলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের অন্ধকার যেন আরও দশ গুণ গাঢ় হয়ে গেল।
তারপর আর কিছু জানি না।
কীরে, ঠিক হ্যায়?
ফেলুদার চেহারাটাই প্রথম দেখতে পেলাম জ্ঞান হয়ে।
ঘাবড়াসনি, আমিও নক-আউট হয়ে গোসলাম দশ মিনিটের জন্য।
এবারে দেখলাম ঘরের অন্য লোকেদের। অমিতাভবাবু তাঁর পাশে একজন মহিলা-নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রী—লালমোহনবাবু, হৃষীকেশবাবু, আর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্যবাবু। এ ঘরটা আগে দেখিনি; বাড়ির বত্ৰিশটা ঘরের কোনও একটা হবে।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। একটা কনকনে ব্যথা থুতনির কাছটায়। তা ছাড়া আর কোনও কষ্ট নেই। ফেলুদা ঘূষিটা খেয়েছিল ডান চোখের নীচে সেটা কালসিটে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্ল্যাক-আই ব্যাপারটা অনেক বিদেশি ছবিতে দেখেছি; স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম।
একমাত্ৰ জটায়ুই অক্ষত, বলল ফেলুদা।
সে কী। আশ্চর্য ব্যাপার তো?–কী করে হল?
মোক্ষম ওয়েপন ওই হামানদিস্তা, বললেন লালমোহনবাবু, হাতে নিয়ে মাথার উপর তুলে হেলিকপটারের মতো বই বাই করে ঘুরিয়ে গেলাম। আমার ধারে কাছেও এগোয়নি। একটি গুণ্ডাও।