এই যে কাজটা করতে বলেছে তার জন্য আপনার পারিশ্রমিক কী?
কচু পোড়া। এ তো হুমকির ব্যাপার। বললে যদি পুলিশে খবর দিই, তা হলে নিঘাত মৃত্যু।
রাত্তিরে দারোয়ান গেটে থাকে না?
থাকে বইকী, কিন্তু আমার ধারণা হয়েছে লোকটা পাঁচিল টপকে আসে।
আপনার ঘর চিনল কী করে?
সাধু দস্তিদারও তো ওই ঘরেই থাকত-চিনবে না কেন?
ভদ্রলোকের ডাক নাম সাধু ছিল বুঝি?
মিঃ হালদারকে তো সেই নামই বলতে শুনেছি।
আপনি তাকে কী বললেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
আমি বললুম, এখন মিঃ হালদারের জিনিসপত্রে কড়া পাহারা, সে কৌটো আমি নেব কী করে? সে বললে, চেষ্টা করলেই পারবে। তুমি মিঃ হালদারের সেক্রেটারি ছিলে; জরুরি কাগজপত্র দেখার জন্য তোমার সে ঘরে ঢোকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে; ব্যস্—এই বলেই সে চলে গেল। আমি জানি, আপনি ছি ছিা করবেন, বলবেন পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল, অন্তত বাড়ির লোককে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু প্রাণের ভয়ের মতো ভয় আর কী আছে বলুন। আপনার কথাটাই মনে হল। আপনিও যে তদন্ত করছেন সেটা আমার মনে হয় সাধু জানে না।
আপনি তা হলে কৌটো বার করেননি।
আপনি কি প্রস্তাব করছেন যে, আমরা সেখানে যাই? আপনারা যদি একটু আগে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন-আমি গেলাম এগারোটায়–তারপর সে এলে যা করার দরকার সে তো আপনিই ভাল বুঝবেন। এইভাবে হাতেনাতে লোকটাকে ধরার সুযোগ তো আর পাবেন না।
পুলিশকে খবর দেব না বলছেন?
অমন সর্বনাশের কথা উচ্চারণ করবেন না, দোহাই। আপনি আসুন, সঙ্গে এঁদেরও নিতে পারেন। তবে সশস্ত্র অবস্থায় যাবেন, কারণ লোকটা ডেঞ্জারাস।
লেগে পড়ুন, বিনা দ্বিধায় বললেন লালমোহনবাবু।রাজস্থানের ডাকাত যখন আমাদের পেছু হটাতে পারেনি, তখন এর জন্য কী ভয়? এ তো নাস্যি মশাই।
আমি অবিশ্যি জায়গাটা দেখিয়ে দেব, বললেন হৃষীকেশবাবু; মেন রোড় ছেড়ে খানিকটা ভেতর দিকে যেতে হয়; স্টেশন থেকে মাইল চারেক।
ফেলুদ রাজি হয়ে গেল। হৃষীকেশবাবু কফি শেষ করে উঠে পড়ে বললেন, দশটা নাগাদ তা হলে আপনারা মিট করছেন আমাকে।
কোথায়?
আমাদের বাড়ি ছড়িয়ে দু ফার্লিং গেলেই একটা তেমাথার মোড় পাবেন। সেখানে দেখবেন একটা মিষ্টির দোকান। সেই দোকানের সামনে থাকব। আমি।
০৫. রাত্রে বিশেষ ট্রাফিক নেই
রাত্রে বিশেষ ট্রাফিক নেই, তাও এক ঘণ্টা হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। খাওয়াটা বাড়িতেই সেরে নিলাম। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যোস নেই। আমাদের; লালমোহনবাবু বললেন, খিদে পেলে ওই মিষ্টির দাকানে ঢুকে পড়া যাবে। কচুরি আর আলুর তরকারি নিঘাত পাওয়া যাবে।
একটা সুবিধে এই যে লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু ফেলুদার ভীষণ ভক্ত। তার উপর বোম্বাই মার্কা ফাইটিং-এর ছবি দেখার সুযোগ ছাড়েন না। কখনও। এ রকম না হলে রান্তবিরেতে বারাসতে ঠ্যাঙতে অনেক ড্রাইভারই গজগজ করত; ইনি যেন নতুন লাইফ পেলেন।
ভি আই পি রোডে পড়ে লালমোহনবাবু গান ধরেছিলেন–জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, কিন্তু ফেলুদা তাঁর দিকে চাইতে অমাবস্যায় গানটা বেমানান হচ্ছে বুঝতে পেরে থেমে গেলেন।
আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। তারার আলো বলে একটা জিনিস আছে, সেটা হয়তো আমাদের কিছুটা হেল্প করতে পারে। ফেলুদার ফরমাশ অনুযায়ী গাঢ় রঙের জামা পরেছি। লালমোহনবাবুর পুলোভারটা ছিল হলদে, তাই তার উপর ফেলুদার রেনকোটটা চাপিয়ে নিয়েছেন। ভদ্রলোক এখন গাড়িতে বক্স; যখন হাঁটবেন তখন একটা পকেট ভীষণ ঝুলে থাকবে, কারণ তাতে ভরা আছে একটা হামানদিস্তার লোহার ভাণ্ডা; ওয়েপন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভদ্রলোক ওটা চেয়ে নিয়েছেন শ্ৰীনাথের কাছে। ফেলুদার পকেটে অবশ্য রয়েছে তার কোল্ট রিভলভার।
আমাদের আন্দাজ ভুল হয়নি; দশটার কিছু আগে আমরা তেমাথায় পৌঁছে গেলাম। মিষ্টির দোকানের পাশেই একটা পানের দোকান—তার সামনে থেকে হৃষীকেশবাবু এগিয়ে এসে আমাদের গাড়িতে উঠে। হরিপদবাবুকে বললেন, ডাইনের রাস্তাটা নিন।
খানিক দূর যেতেই বাড়ি কমে এল। আলোও বেশি নেই; রাস্তায় যা আলো ছিল তাও ফুরিয়ে গেল বাঁয়ে মোড় নিতে। বুঝলাম এটা প্রায় পল্লীগ্রাম অঞ্চল।বারাসতেই ছিল প্রথম নীলকুঠি। বললেন হৃষীকেশবাবু। এ দিকটাতে এককালে অনেক সাহেব থাকত; দিনের আলোয় তাদের সব ভাঙা বাগানবাড়ি দেখতে পেতেন।
মিনিট কুড়ি চলার পর একটা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন হৃষীকেশবাবু।
আসুন।
গাড়ি থেকে নামলাম চার জনে।গাড়িটা এখানেই ওয়েট করুক, বললেন হৃষীকেশবাবু, আমি আপনাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি, তারপরে এই গাড়িই আমাকে বাড়ি পৌঁছে আসব।
লালমোহনবাবু, হরিপদবাবুকে টাকা দিয়ে বললেন, তুমি এঁকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় কোনও দোকান-টোকান থেকে খাওয়াটা সেরে নিও। ফিরতে রাত হবে। আমাদের।
ঘাসের উপর দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে একটা জংলা জায়গা এসে পড়ল।
এখানেই ছিল মধুমুরলীর দিঘি, বললেন হৃষীকেশবাবু। আমাদের যেতে হবে ওখানটায়।
খুবই কম আলো, কিন্তু তাও বুঝতে পারছি যে গাছপালা ছাড়াও ও দিকে একটা দালানের ভগ্নস্তৃপ রয়েছে। শীতকাল বলে রক্ষে, না হলে এ জায়গাটা হত সাপ ব্যাঙের ডিপো!
এখন টর্চের আলোটা বোধহয় তেমন বিপজ্জনক কিছু নয়, বলল ফেলুদা।
মনে তো হয় না, বললেন হৃষীকেশীবাবু।
ছোট্ট পকেট টর্চের আলোতে ঝোপঝাড় খানাখন্দ বাঁচিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলকুঠির ভগ্নস্তূপের পাশে।