- বইয়ের নামঃ নেপোলিয়নের চিঠি
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ফেলুদা সমগ্র
০১. তুমি কি ফেলুদা
তুমি কি ফেলুদা?
প্রশ্নটা এল ফেলুদার কোমরের কাছ থেকে। একটি বছর ছয়েকের ছেলে ফেলুদার পাশেই দাঁড়িয়ে মাথাটাকে চিত করে তার দিকে চেয়ে আছে। এই সে দিনই একটা বাংলা কাগজে ফেলুদার একটা সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে, তার সঙ্গে হাতে চারমিনার নিয়ে একটা ছবি। তার ফলে ফেলুদার চেহারাটা আজকাল রপ্তাঘাটে লোকে ফিল্মস্টারের মতোই চিনে ফেলছে। আমরা এসেছি। পার্ক স্ট্রিট আর রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে খেলনা আর লাল মাছের দোকান হবি সেন্টারে। সিধুজ্যাঠার সত্তর বছরের জন্মদিনে তাঁকে একটা ভাল দাবার সেট উপহার দিতে চায় ফেলুদা।
ছেলেটির মাথায় আলতো করে হাত রেখে ফেলুদা বলল, ঠিক ধরেছ তুমি।
আমার পাখিটা কে নিয়েছে বলে দিতে পারো? বেশ একটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলল ছেলেটি। ততক্ষণে ফেলুদারই বয়সী এক ভদ্রলোক ব্ৰাউন কাগজে মোড়া একটা লম্বা প্যাকেট নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন, তাঁর মুখে খুশির সঙ্গে একটা অপ্রস্তুত ভাব মেশানো।
তোমার নিজের নামটাও বলে দাও ফেলুদাকে, বললেন ভদ্রলোক।
অনিরুদ্ধ হালদার, গম্ভীর মেজাজে বলল ছেলেটা।
ইনি আপনার খুদে ভক্তদের একজন, বললেন ভদ্রলোক। আপনার সব গল্প ওর মার কাছ থেকে শোনা।
পাখির কথা কী বলছিল?
ও কিছু না, ভদ্রলোক হালকা হেসে বললেন, পাখি পোষার শখ হয়েছিল, তাই ওকে একটা চন্দনা কিনে দিয়েছিলাম। যে দিন আসে সে দিনই কে খাঁচা থেকে পাখিটা বার করে নিয়ে যায়।
খালি একটা পালক পড়ে আছে, বলল ফেলুদার খুদে ভক্ত।
তাই বুঝি?
রাত্তিরে ছিল পাখিটা, সকালবেলা নেই। রহস্য।
তই তো মনে হচ্ছে। তা অনিরুদ্ধ হালদার এই রহস্যের ব্যাপারে কিছু করতে পারেন না?
আমি বুঝি গোয়েন্দা? আমি তো ক্লাস টু-তে পড়ি।
ছেলের বাবা আর বেশিদূর কথা এগোতে দিলেন না।
চলো অনু। আমাদের আবার নিউ মার্কেট যেতে হবে। তুমি বরং ফেলুদাকে এক’দিন আমাদের বাড়িতে আসতে বলো।
ছেলে বাবার অনুরোধ চালান করে দিল। এবার ভদ্রলোক একটা কার্ড বের করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন, আমার নাম অমিতাভ হালদার।
ফেলুদা কার্ডটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলল, বারাসতে থাকেন দেখছি।
আপনি হয়তো আমার বাবার নাম শুনে থাকতে পারেন। পার্বতীচরণ হালদার।
হ্যাঁ হ্যাঁ! ওঁর লেখা-টেখাও তো পড়েছি। ওঁরই সব নানারকম জিনিসের কালেকশন আছে না?
ওটা বাবার নেশা। ব্যারিস্টারি ছেড়ে এখন ওসবই করেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন ওই সবের পিছনে। আপনার তো অনেক ব্যাপারে ইয়ে আছে, আমার মনে হয় আপনি দেখলে আনন্দ পাবেন। আদ্যিকালের গ্রামোফোন, মুগল আমলের দাবা বড়ে, ওয়ারেন হেস্টিংসের নাস্যির কোটা, নেপোলিয়নের চিঠি…। তা ছাড়া আমাদের বাড়িটাও খুব ইন্টারেস্টিং।দেড়শো বছরের পুরনো। এক দিন যদি ফ্রি থাকেন, একটা ফোন করে দিলে—রোববার-টাববার…। আমিই বরং একটা ফোন করব। ডাইরেকটরিতে তো আপনার—?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নামেই আছে। এই যে।
ফেলুদাও তার একটা কার্ড ভদ্রলোককে দিয়ে দিল।
কথা হয়ে গেল আমরা এই মাসেই এক দিন বারাসত গিয়ে হাজির হব। লালমোহনবাবুর গাড়ি আছে, যাবার কোনও অসুবিধে নেই। এখানে বলে রাখি, লালমোহনবাবু বহাল তবিয়তে এবং খোশমেজাজে আছেন, কারণ এই পুজোয় জটায়ুর জায়ান্ট অমনিবাস বেরিয়েছে, তাতে বাছাই করা দশটা সেরা রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস। দাম পঁচিশ টাকা এবং লালমোহনবাবুর ভাষায় সেলিং লাইক হট কচুরিজ।
সন্ধ্যাবেলা ফেলুদার মুখ শুকনো দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার। ও বলল, খুদে মক্কেলের আরজিটা মাথায় ঘুরছে রে।
সেই চন্দনার ব্যাপারটা?
খাঁচা থেকে পাখি চুরি যায় শুনেছিস কখনও?
তা শুনিনি সেটা স্বীকার করতেই হল। –তুমি কি এর মধ্যেও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ নাকি?
ব্যাপারটা ঠিক দৈনন্দিন ঘটনার মধ্যে পড়ে না; চন্দনা তো আর বার্ড অফ প্যারাড়াইজ নয়। এক যদি না কারও নেগলিজেন্সে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করতে ভুল হয়ে গিয়ে থাকে।
কিন্তু সেটা তো আর জানিবার কোনও উপায় নেই।
তা থাকবে না কেন? ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আসলে বুঝতে পারছি এ ব্যাপারটা ও-বাড়ির কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি। ঘটনাটা যে অস্বাভাবিক সেটা কারুর মাথায় ঢেকেনি। অথচ ছেলের মনটা যে খচু খচু করছে সেটা বুঝতে পারছি, না হলে আমায় দেখে ও কথাটা বলত না। অন্তত একবার যদি গিয়ে দেখা যেত…
তা ভদ্রলোক তো বললেনই যেতে।
হ্যাঁ-কিন্তু সেটাও হয়তো আমাকে সামনা-সামনি দেখলেন বলে। বাড়ি ফিরে সে কথা আর মনে নাও থাকতে পারে। ছোট ছেলের অনুরোধ বলেই মনে হচ্ছে সেটাকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
ক্রিসমাসের যখন আরু পাঁচ দিন বাকি তখনই এক শনিবারের সকালে এসে গোল অমিতাভবাবুর ফোন। আমি কলটা ফেলুদার ঘরে ট্রানসফার করে বসবার ঘরের মেন টেলিফোনে কান লাগিয়ে শুনলাম।
মিঃ মিত্তির?
বলুন কী খবর।
আমার ছেলে তো মাথা খেয়ে ফেলল। কবে আসছেন?
পাখির কোনও সন্ধান পেলেন?
নাঃ–সে আমার পাওয়া যাবে না।
ভয় হয়, আপনার ছেলে যদি ধরে বসে থাকে তার পাখি উদ্ধার করে দেব, তখন সেটা না। পাওয়া গেলে তো বেইজ্জতের ব্যাপার হবে।