মিঃ সেনগুপ্ত, আমি অত্যন্ত সাবধানী লোক। গোপন ব্যাপার কী করে গোপন রাখতে হয় তা আমি জানি। আমার উপর আপনি সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেন। তবে আপনি যদি ঘন ঘন ডাঃ মুনসীকে হুমকি চিঠি দেন, তার ফল কী হবে সেটা আমি জানি।
আমি হুমকি চিঠি দেব না কেন? আপনি ডায়রিটা পড়েছেন?
পড়েছি।
আপনার কী মনে হয়েছে?
ত্রিশ বছরের পুরনো ঘটনা। এর মধ্যে অন্তত শ পাঁচেক ব্যাঙ্কে তহবিল তছরুপ হয়েছে। যারা এ কাজ করেছে। হয়তো তাদের অনেকেরই নামের প্রথম অক্ষর এ। সুতরাং আপনার ভয় সম্পূর্ণ অমূলক।
মুনসী কি ব্যাংকের নাম করেছে?
না।
আমার ব্যাঙ্কে দুজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল যারা চুরির ব্যাপারে আমাকে সন্দেহ করে, কারণ ঠেকায় পড়ে আমি দুজনের কাছে টাকা ধার চেয়েছিলাম। দুজনেই অবিশ্যি রিফিউজ করে।
মিঃ সেনগুপ্ত, আমি আবার বলছি—আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। আর এই ধরনের চিঠি দিয়ে আপনার লাভটা কী হচ্ছে? ডাঃ মুনসী আইনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদ। অর্থাৎ আপনি কোনও লিগ্যাল স্টেপ নিতে পারছেন না। তা হলে কি আপনি আইনের বাইরে কোনও রাস্তা ভাবছেন?
আমার বিপদের আশঙ্কা দেখলে আমি আইন-টাইন মানব না। মিঃ মিত্তির। আমার অতীতের ইতিহাস থেকেই আপনি বুঝছেন যে প্রয়োজনে বেপরোয়া কাজ করতে আমি দ্বিধা করি না।
আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, মি সেনগুপ্ত। তখনকার আপনি আর এখনকার আপনি কি এক? আজ আপনি সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি। এই অবস্থায় আপনি এমন একটা ঝুঁকি নেবেন?
মিঃ সেনগুপ্ত মিনিট খানেক কিছু না বলে চুক চুক করে বিয়ার খেলেন। তারপর তাঁর চাউনির সামান্য পরিবর্তন দেখা গেল। তারপর তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক চুমুকে বাকি বিয়ারটা শেষ করে গেলাসটা টেবিলে রেখে বললেন, ঠিক আছে—ড্যাম ইট! লেট হিম গো অ্যাহেড।
আপনি তা হলে হুমকির ব্যাপারে ইতি দিচ্ছেন?
ইয়েস ইয়েস ইয়েস!—তবে বিপদের বিন্দুমাত্র আশঙ্কা দেখলেই কিন্তু—
আর বলতে হবে না, বলল ফেলুদা, বুঝেছি।
০৫. পাণ্ডুলিপিটা ফেরত নিয়ে এলেন
লালমোহনবাবু কথামতো পরদিন সকালেই পাণ্ডুলিপিটা ফেরত নিয়ে এলেন। ফেলুদা বলল, এখন আর চা খাওয়া হবে না। কারণ আধা ঘণ্টার মধ্যেই জি-র সঙ্গে অ্যাপায়েন্টমেন্ট।
নব্বই নম্বর রিপন স্ট্রিটের দরজায় বেল টিপতে যাঁর আবির্ভাব হল তাঁর মাথায় টাক, কনের পাশের চুল সাদা, আর এক জোড়া বেশ তাগড়াই গোঁফ, তাও সাদা।
মিঃ মিটার, আই অ্যাম জর্জ হিগিন্স।
তিনজনের সঙ্গেই করমর্দনের পর হিগিন্স। আমাদের নিয়ে দোতলায় চলল। গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকেই দুটো বেশ বড় খাঁচা দেখেছি, তার একটায় বাঘ, অন্যটায় হয়না। দোতলায় উঠে বাঁয়ে একটা ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম তাতে গোটা পাঁচেক কোয়ালা ভালুক বসে। আছে মেঝেতে।
বসবার ঘরে পৌঁছে সোফায় বসে হিগিন্স ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল, ইউ আর এ ডিটেকটিভ?
এ প্রাইভেট ওয়ান, বলল ফেলুদা।
বাকি কথাও ইংরেজিতেই হল, যদিও হিগিন্স মাঝে মাঝে হিন্দিও বলে ফেলছিলেন, বিশেষ করে কারুর উদ্দেশে গালি দেবার সময়। অনেকের উপরেই ভদ্রলোকের রাগ। যদিও কারণটা বোঝা গেল না। অবশেষে বললেন, মানসি তা হলে এখনও প্র্যাকটিস করে? আই মাস্ট সে, সে আমার বিপদের সময় অনেক উপকার করেছিল।
তা হলে আর আপনি তাকে শাসচ্ছেন কেন? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
হিগিন্স। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটার একটা কারণ হচ্ছে সেদিন রাত্রে নেশার মাত্রাটা একটু বেশি হয়েছিল। তবে মানুষের কি ভয় করে না? আমার বাবা কী ছিলেন জান? স্টেশন মাস্টার। আর আমি নিজের চেষ্টায় আজ কোথায় এসে পৌঁছেছি। দেখ। এ আমার একচেটিয়া ব্যবসা। মানসির ডায়ারি ছাপা হলে যদি আমাকে কেউ চিনে ফেলে তা হলে আমার আর আমার ব্যবসার কী দশা হবে ভাবতে পার?
ফেলুদাকে আবার বাঝাতে হল যে হিগিন্স আইন বাঁচিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। তাঁকে আরার বেঁকা রাস্তায় যেতে হবে। সেটাই কি তুমি চাইছ? বেশ জোরের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। তাতে কি তোমার প্রেসটিজ আরও বেশি বিপন্ন হবে না?
হিগিন্স কিছুক্ষণ চুপ করে বিড়বিড় করে বললেন, একবার কেন, শতিকার খুন করতে পারতাম ও পাজি সুইডিশটাকে। বাহাদুর, আমার সাধের লেপার্ড, মাত্র চার বছর বয়স, তাকে কিনা লোকটা মেরে ফেলল!…
আবার দশ সেকেন্ডের জন্য কথা বন্ধ; তারপর হঠাৎ সোফার হাতল চাপড়ে গলা তুলে হিগিন্স বললেন, ঠিক আছে; মানসিকে বলে আমি কোনও পরোয়া করি না। ও যা করছে করুক, বই বেরোলে লোকে আমাকে চিনে ফেললেও আই ডোন্ট কেয়ার। আমার ব্যবসা কেউ টলাতে পারবে না।
থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ হিগিন্স, থ্যাঙ্ক ইউ।
অরুণ সেনগুপ্তর খবরটা ফেলুদা আগেই ফোনে ডাঃ মুনসীকে জানিয়ে দিয়েছিল। হিগিনসের খবরটা দিতে আমরা মুনসির বাড়িতে গোলাম, কারণ পাণ্ডুলিপিটা ফেরত দেবার একটা ব্যাপার ছিল। ভদ্রলোক ফেলুদাকে একটা বড় ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, তা হলে তো আপনার কর্তব্য সারা হয়ে গেল! এবারে আপনার ছুটি!
আপনি ঠিক বলছেন? আর সম্বন্ধে কিছু করার নেই তো?
নাথিং। …আপনি আপনার বিল পাঠিয়ে দেবেন, আমি ইমিডিয়েটলি পেমেন্ট করে দেব।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।
এটাকে কি মামলা বলা চলে? বাড়ি ফিরে এসে বলল জটায়ু।
মিনি মামলা বলতে পারেন। অথবা মামলাণু।