কী রকম?
ইনি যে ফিরিঙ্গি সে তো জানেন। আর এর ব্যবসার কথাও জানেন। নব্ববুই নম্বর রিপন স্ট্রিটে একটা বড় দোতলা বাড়িতে থাকতেন জর্জ হিগিন্স। ১৯৬০-এ এক সুইডিশ ফিল্ম পরিচালক কলকাতায় আসেন ভারতবর্ষের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা ছবি করবেন বলে। তাঁর গল্পের জন্য একটা লেপার্ডের প্রয়োজন ছিল। ইনি হিগিনসের খবর পেয়ে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন। হিগিনসের একটা লেপার্ড ছিল বটে, কিন্তু সেটা রপ্তানির জন্য নয়; সেটা তার পোষা! অনেক টাকা দিয়ে সুইডিশ পরিচালক একমাসের জন্য লেপার্ডটাকে ভাড়া করেন। কথা ছিল একমাস পরে তিনি অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেবেন! আসলে ফিল্ম পরিচালক মিথ্যা কথা বলেন, কারণ তাঁর গল্পে ছিল গ্রামবাসীরা সবাই মিলে লেপাড়ীটাকে মেরে ফেলে। এক মাস পরে পরিচালক এসে হিগিন্সকে আসল ঘটনা বলে। হিগিন্স প্রচণ্ড রেগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে তখনই পরিচালকের টুটি টিপে তাকে মেরে ফেলে। পরমুহূর্তে রাগ চলে গিয়ে তার জায়গায় আসে আতঙ্ক! কিন্তু সেই অবস্থাতেও পুলিশের চোখে ধুলো দেবার ফন্দি হিগিন বার করে। সে প্রথমে ছুরি দিয়ে মৃত পরিচালকের সর্বাঙ্গ ক্ষতচিহ্নে ভরিয়ে দেয়। তারপর তার কালেকশনের একটা হিংস্র। বনবেড়ালকে খাঁচার দরজা খুলে বার করে সেটাকে গুলি করে মারে। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়ায়, খাঁচা ছাড়া বনবেড়াল পরিচালককে হত্যা করে এবং বনবেড়ালকে হত্যা করে হিগিন্স। ফিকিরাটা কাজে দেয়, হিগিন্স, আইনের হাত থেকে বঁচে। কিন্তু তারপর একমাস ধরে ক্রমাগত স্বপ্নে নিজেকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে দেখে অগত্যা মুনসীর চেম্বারে গিয়ে হাজির হয়।
হুঁ.. বললেন জটায়ু। তা হলে এখন কিং কর্তব্য?
দুটো কর্তব্য, বলল ফেলুদা। এক হল পাণ্ডুলিপিটা আপনাকে দেওয়া, আর দুই—এ-কে একটা টেলিফোন করা।
জটায়ু হাসিমুখে ফেলুদার হাত থেকে পাণ্ডুলিপি ভরা মোটা খামটা নিয়ে বললেন, ফোন করবেন কি অ্যাপায়েন্টমেন্ট করার জন্য?
ন্যাচারেলি, বলল ফেলুদা। আর দেরি করার কোনও মানে হয় না। তোপ্সে-এ, সেনগুপ্ত, ১১ রোল্যান্ড রোড, নম্বরটা বার করা তো।
আমি ডাইরেক্টরিটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠল। আমিই ধরলাম। ডাঃ মুনসী। ফেলুদাকে বলতেই ও আমার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিল।
ব্যাপার আর কিছুই নয়-সেনগুপ্ত আরেকটা হুমকি চিঠি দিয়েছেন। তাতে কী বলা হয়েছে। সেটা ফেলুদা তার খাতায় লিখে নিল। তারপর ফেলুদা তার শেষ কথাটা বলে ফোনটা রেখে দিল।
সেনগুপ্তর দ্বিতীয় হুমকিটা হচ্ছে এই—সাতদিন সময়। তার মধ্যে কলকাতার প্রত্যেক বাংলা ও ইংরিজি কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখতে চাই যে অনিবাৰ্য কারণে ডায়ারি ছাপা সম্ভব হচ্ছে না। সাতদিন। তারপরে আর হুমকি নয়–কাজ, এবং কাজটা আপনার পক্ষে প্রীতিকর হবে না বলাই বাহুল্য!
আমি সেনগুপ্তর ফোন নম্বর বার করে ডায়াল করে একবারেই লাইন পেয়ে গেলাম। ফেলুদার হাতে ফোনটা চালান দিয়ে আমি আর জটায়ু কেবল ফেলুদার কথাটাই শুনলুম। সেটা শুনে যা দাঁড়াল তা এই—
হ্যালো-মিঃ সেনগুপ্তর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি কি। –অরুণ সেনগুপ্ত?
—
মিঃ সেনগুপ্ত? আমার নাম প্রদোষ মিত্র।
—
হ্যাঁ, ঠিকই রেছেন। ইয়ে-আমায় একদিন পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারেন?
—
তাই বুঝি? আশ্চর্য তো! কী ব্যাপার?
—
তা পারি বইকী। কটায় গেলে আপনার সুবিধে?
—
ঠিক আছে। তাই কথা রইল।
ভাবতে পারিস? ফোনটা রেখে বলল ফেলুদা, ভদ্রলোক নাকি আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই
কেন, কেন? প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
সেটা ফোনে বললেন না, সামনে বলবেন।
কখন অ্যাপায়ন্টমেন্ট?
আধা ঘণ্টা বাদে।
০৪. এগারো নম্বর রোল্যান্ড রোড
এগারো নম্বর রোল্যান্ড রোড সাহেবি আমলের দোতলা বাড়ি। দরজার বেল টিপতে একজন উর্দিপরা বেয়ারার আবিৰ্ভাব হল। সে কার্পেট ঢাকা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আমাদের দোতলায় নিয় গিয়ে বৈঠকখানায় বসাল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মিঃ সেনগুপ্ত প্রবেশ করলেন। বাড়ির সঙ্গে মানানসই সাহেবি মেজাজ, পরনে ড্রেসিং গাউন, পায়ে বেডরুম স্লিপার, হাতে চুরুট।
পরিচয় পর্ব শেষ হলে পার ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা ড্রিঙ্ক করেন?
আজ্ঞে না, বলল ফেলুদা।
আমি যদি বিয়ার খাই আশা করি আপনারা মাইন্ড করবেন না?
মোটেই না।
ভদ্রলোক বেয়ারাকে ডেকে নিজের জন্য বিয়ার আর আমাদের তিনজনের জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেলুদার দিকে দৃষ্টি দিলেন। ফেলুদা বলল, আপনি আমাকে কেন ফোন করতে যাচ্ছিলেন সেটা আগে বলতে আপনার কোনও আপত্তি আছে? তারপর আমার দিকটা বলব।
বেশ তো। জে. পি. চাওলার নাম শুনেছেন?
ব্যবসাদার? গুরুপ্ৰসাদ চাওলা? যার নামে চাওলা ম্যানসনস?
হ্যাঁ।
তাঁর এক নাতি তো–?
হ্যাঁ। মিসিং। সম্ভবত কিডন্যাপড।
কাগজে দেখছিলাম ধটে।
গুরুপ্ৰসাদ আমার অনেকদিনের বন্ধু! পুলিশ তদন্ত করছে বটে, কিন্তু আমি ওকে আপনার নাম সাজেস্ট করি। ভুলু সেহানবিশের কাছে আপনার খুব সুখ্যাতি শুনেছি।
হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে ওঁকে আমি হেলপ করি।
তা হলে চাওলাকে কী বলব?
মিঃ সেনগুপ্ত, দুঃখের বিষয় আমি অলরেডি একটা কেস হাতে নিয়ে ফেলেছি।
আই সি।
আর সেই ব্যাপারেই আমি আপনার কাছে এসেছি।
কী ব্যাপারে শুনি?
আমি ডাঃ মুনসীর কাছ থেকে আসছি।
হোয়াট!
ভদ্রলোক সোফা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন–মুনসী আপনাকে আমার পরিচয় দিয়ে দিয়েছে? তার মানে তো আর ক’দিনে রাজ্যিসুদ্ধ লোক জেনে যাবে মুনসীর ডায়েরির এ ব্যক্তিটি আসলে কে।