এদের অপরাধগুলো?
শুনুন আমার পাণ্ডুলিপি আজ আপনি নিয়ে যাবেন। মন দিয়ে পড়ে আপনার বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে আমাকে বলবেন এতে আপত্তিকর কিছু আছে কিনা যার ফলে বইটা বাজারে বেরোলে আমার ক্ষতি হতে পারে।
ঠিক আছে তা হলে—
ফেলুদাকে থামতে হল, কারণ ঘরে তিনজন লোকের প্রবেশ ঘটেছে। ডাঃ মুনসী তাদের দিকে দেখিয়ে বললেন, আপনি আসছেন শুনে এরা সকলেই আপনাকে দেখার ইচ্ছা প্ৰকাশ করেছেন। আমার স্ত্রী ছাড়া এই কজন এবং আমার ছেলেই এখন আমার বাড়ির বাসিন্দা। আলাপ করিয়ে দিই, এ হচ্ছে সুখময় আমার সেক্রেটারি।
একজন চশমা-পরা বছর চল্লিশেকের ভদ্রলোকের দিকে দেখালেন ডাঃ মুনসী।
আর ইনি হচ্ছেন আমার শ্যালক চন্দ্রনাথ।
এর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। দেখে কেন জানি মনে হয় ইনি বিশেষ কিছু করেন-টরেন না, এ বাড়িতে আশ্রিত হয়ে রয়েছেন।
আর ইনি আমার পেশেন্ট রাধাকান্ত মল্লিক। এর চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই আছেন।
এঁকে দেখে মনে হয় এর অসুখ এখনও সারেনি। হাত কচলাচ্ছেন, চোখ পিট পিট করছেন, আর একটানা সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বয়স আন্দাজ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ।
পরিচয়ের পরে একমাত্র সুখময়বাবু ছাড়া আর সকলেই চলে গেলেন। ডাঃ মুনসী সেক্রেটারির দিকে ফিরে বললেন, সুখময়, যাও, আমার লেখাটা এনে প্রদোষিবাবুকে দাও।
ভদ্রলোক দু মিনিটের মধ্যে একটা বড়, মোটা খাম এনে ফেলুদাকে দিলেন।
ওর কিন্তু আর কপি নেই, বললেন ড. মুনসীর পাবলিশারকে দেবার আগে ওটা সুখময় টাইপ করে দেবে।
আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, বলল ফেলুদা, আমি এটার মূল্য খুব ভালভাবেই জানি।
আমরা উঠে পড়লাম। শঙ্করবাবু পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। এবার এসে আমাদের সদর দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন। তারপর লালমোহনবাবুর সবুজ অ্যাম্বাসডরে চড়ে আমরা বাড়িমুখে রওনা দিলাম!
একটা রিকুয়েস্ট আছে, লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন।
কী?
আপনার পড়া হলে পরা আমি একবার দু দিনের জন্য পাণ্ডুলিপিটা নেব। এটা রিফিউজ করবেন না, প্লিজ!
আপনার না পড়লেই নয়?
না-পড়লেই নয়। বিশেষ করে শিকার কাহিনী পড়তে আমার দুর্দান্ত লাগে।
বেশ দেব। আর দুদিন নয়; আপনি যে সকালে নেবেন, তার পরের দিন সকালেই ফেরত দিতে হবে। তার মধ্যে শিকারের অংশ আপনার নিশ্চয়ই পড়া হয়ে যাবে। কারণ ১৯৬৫-এর পর তো আর ভদ্রলোক শিকার করেননি।
তাই সই।
০৩. ডাঃ মুনসীর হাতের লেখা
ডাঃ মুনসীর হাতের লেখা বেশ পরিষ্কার হলেও, তিনশো পচাত্তর পাতার পাণ্ডুলিপিটা পড়তে ফেলুদার লাগল। তিন দিন! এত সময় লাগার একটা কারণ অবিশ্যি এই যে ফেলুদা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেক কিছু নিজের খাতায় নোট করে নিচ্ছিল।
তিন দিনের পরের দিন রবিবার সকালে যথারীতি জটায়ু এসে হাজির। প্ৰথম প্রশ্নই হল,কী স্যার, হল?
হয়েছে।
আপনি কী সিদ্ধান্তে এলেন শুনি! এ ডায়রি নির্ভয়ে ছাপার যোগ্য?
সম্পূর্ণ। তবে তাতে হুমকি বন্ধ করা যায় না। এই তিনজনের একজনও যদি ধরে বসে থাকে যে নামের আদ্যক্ষর থেকেই লোকে বুঝে ফেলবে কার কথা বলা হচ্ছে তা হলে সে এ বই ছাপা বন্ধ করার জন্য কী যে না করতে পারে তার ঠিক নেই!
ইভ্ন মার্ডার?
তা তো বটেই। একজনের কথাই ধরা যাক। এ। অরুণ সেনগুপ্ত। পূর্ববঙ্গের এক জমিদার বংশের ছেলে। যুবা বয়সে ছিলেন এক ব্যাঙ্কের মধ্যপদস্থ কর্মচারী। কিন্তু রক্তের মধ্যে ছিল চূড়ান্ত শৌখিনতা। ফলে প্রতি মাসেই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। শেষে কাবুলিওয়ালার শরণাপন্ন হওয়া।
এই ফাঁকে বলে রাখি, ফেলুদা একবার বলেছিল যে আজকাল আর দেখা যায় না বটে। কিন্তু বছর কুড়ি আগেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যেত লাঠি হাতে কাবুলিওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। এদের ব্যবসা ছিল মোটা সুদে টাকা ধার দেওয়া।
ফেলুদা বলে চলল, একটা সময় আসে যখন দেনার অঙ্কটা এমন ফুলে ফেপে ওঠে যে মরিয়া হয়ে অরুণ সেনগুপ্তকে ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে চল্লিশ হাজার টাকা চুরি করতে হয়। কিন্তু সেটা সে এমন কৌশলে করে যে দোষটা গিয়ে পড়ে একজন নির্দোষ কর্মচারীর উপর। ফলে সে বেচারিকে জেল খাটতে হয়।
বুঝেছি, বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন জটায়ু তারপর অনুশোচনা, তারপর মাথার ব্যারাম, তারপর মনোবিজ্ঞানী। ..কিন্তু ভদ্রলোক যে এখন একেবারে সমাজের উপর তলায় বাস করছেন। তার মানে মুনসীর চিকিৎসায় কাজ দিয়েছিল?
তা তো বটেই। সে কথা মুনসী তাঁর ডায়রিতে লিখেওছেন—যদিও তারপরে আর কিছু লেখেননি। কিন্তু আমরা বেশ অনুমান করতে পারি যে এই ঘটনার পর সেনগুপ্ত নিশ্চয়ই তার জীবনের ধারা পালটে ফেলে ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে উপরে উঠে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছেন। বুঝতেই পারেন। সেখান থেকে আবার পিছলে পড়ার আশঙ্কা যদি দেখা দেয়, যতই অমূলক হাক, তা হলে সেনগুপ্ত সাহেব মাথা ঠিক রাখেন কী করে?
বুঝলাম, বললেন জটায়ু, আর অন্য দুজন?
আর ব্যক্তি সম্বন্ধে চিন্তার কোনও কারণ নেই সে তো সেদিন মুনসীর মুখেই শুনলেন। এর আসল নামটা উনি বলেননি, তাই আমিও বলতে পারছি না। ইনি এককালে একটা লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মারেন, তারপর এদিকে ওদিকে মোটা ঘুষ দিয়ে আইনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচান। ইনিও ডাঃ মুনসীর হাতে নিজেকে সমৰ্পণ করে বিবেকযন্ত্রণা থেকে রেহাই পান!..ইন্টারেস্টিং হল জি-র ঘটনা।