এবং তাঁর ডায়রিও পড়েননি?
না। শুধু আমি না, কেউই পড়েনি।
আসল প্রসঙ্গ থেকে আমরা একটু দূরে সরে এসেছি। ওই চিঠি কি এই তিনজনের একজন লিখেছেন?
ইয়েস, ইয়েস। এই দেখুন।
শঙ্করবাবু একটা খাম বার করে ফেলুদাকে দিলেন। তা থেকে যে চিঠিটা বেরোল সেটা ফেলুদার পিছনে দাঁড়িয়ে আমি আর লালমোহনবাবুও পড়লাম। প্রথমেই তলায় দেখলাম এ। তার উপর লেখা আই টেক ব্যাক মাই ওয়ার্ড। ডায়রি ছাপতে হলে আমার অংশ বাদ দিয়ে ছাপতে হবে। এটা অনুরোধ নয়, আদেশ। অমান্য করলে তার ফল ভোগ করতে হবে।
একটা প্রশ্ন আছে, বলল ফেলুদা। এই তিন ব্যক্তির অপরাধের কথা আপনার বাবা জানলেন। কী করে?
সেও খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কৌশলে আইনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে এ, জি আর আর মনে শান্তি পায়নি। গভীর অনুশোচনা, শেষটায় ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে যাবার ভয় ক্ৰমে মানসিক ব্যারামে দাঁড়ায়। বাবার তখনই বেশ নাম ডাক, এরা তিনজনেই বাবার কাছে আসে চিকিৎসার জন্য। সাইকায়াট্রিস্টের কাছে তো আর কিছু লুকোনো চলে না; সব প্রশ্নের সঠিক জবাব না দিলে চিকিৎসাই হবে না। এই ভাবে বাবা এদের ঘটনাগুলো জানতে পারেন।
হুমকি কি শুধু এ-ই দিয়েছে?
এখন পর্যন্ত তাই, তবে জি সম্বন্ধেও বাবার সংশয় আছে! এই তিনজনের অপরাধ কী তা আপনি জানেন? না। শুধু তাই না; এদের আসল নাম, এখন এরা কী করছে, এসব কিছুই বলেননি। বাবা। তবে আপনাকে নিশ্চয়ই বলবেন।
উনি কি আমার খোঁজ করছেন?
সেই জন্যেই তো এলাম। বাবা ওঁর এক পেশেন্টের কাছ থেকে আপনার নাম শুনেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতে আমি বললাম গোয়েন্দা হিসেবে আপনার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। তাতে বাবা বললেন, মানুষের মনের চাবিকাঠি হাতে না থাকলে ভাল গোয়েন্দা হওয়া যায় না। ওঁকে একটা কল দিতে পারলে ভাল হত। এইসব হুমকি-টুমকিতে শান্তিভঙ্গ হয়। ফলে কাজের ব্যাঘাত হয়। সেটা আমি একেবারেই চাই না। আমি তখনই বাবাকে জিজ্ঞেস করি মিত্তিরকে কখন আসতে বলব। বাবা বললেন, রবিবার সকাল দশটা। এখন আপনি যদি…
বেশ তো; আমার দিক থেকে আপত্তি করার তো কোনও কারণই নেই।
তা হলে এই কথা রইল। রবিবার সকাল দশটা, নাম্বার সেভ্ন সুইনহো স্ট্রিট।
০২. সাত নম্বর সুইনহো স্ট্রিট
সাত নম্বর সুইনহো স্ট্রিট ডাক্তারের বাড়ি বলে মনেই হয় না; তার সদর দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে একটা দাঁড়ানো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আর তার পিছনে দেয়ালে উপর দিকে একটা বাইসনের মাথা।
শঙ্করবাবু নীচেই অপেক্ষা করছিলেন, আমরা তাঁর সঙ্গে দোতলায় গিয়ে বৈঠকখানায় বসলাম! এঘরেও চতুর্দিকে শিকারের চিহ্ন। ভদ্রলোক ডাক্তগরি করে এত জানোয়ার মারার সময় কী করে পেলেন। তাই ভাবছিলাম।
মিনিট খানেকের মধ্যেই ডাঃ মুনসী এসে পড়লেন। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, তবে এখনও যে বেশ শক্ত সমর্থ সেটা দেখলেই বোঝা যায়। ভদ্রলোক ফেলুদার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আপনার তো ব্যায়াম করা শরীর বলে মনে হচ্ছে। ভেরি গুড। আপনার কাজ প্রধানত মাথার হলেও আপনি যে শরীরের প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন সেটা দেখে ভাল লাগল।
এবার ভদ্রলোক জটায়ু ও আমার দিকে চাইতে ফেলুদা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল।
এঁরা ট্রাস্টওয়ার্দি কি? ডাঃ মুনসী প্রশ্ন করলেন।
সম্পূর্ণ, বলল ফেলুদা। তপেশ আমার খুড়তুতো ভাই এবং আমার সহকারী, আর মিঃ গাঙ্গুলী আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।
এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি কারণ আজ সেই তিন ব্যক্তির আসল পরিচয় আমাকে দিতে হবে, না হলে আপনি কাজ করতে পারবেন না। এই পরিচয় শুধু আপনারা তিনজনই জানবেন, আর কেউ জানে না, আর কাউকে বলিনি।
আপনি নিৰ্ভয়ে বলতে পারেন, ডাঃ মুনসী, বললেন জটায়ু। আমি অন্তত আর কাউকে বলব না।
ভেরি ওয়েল।
তা হলে বলুন কী করতে পারি। হুমকি চিঠির কথা আপনার ছেলে বলেছেন।
শুধু হুমকি চিঠি নয়, বললেন ডাঃ মুনসী, হুমকি টেলিফোনও বটে। এটা কাল রাত্রের ঘটনা। তখন সাড়ে এগারোটা। বোঝাই যায় মত্ত অবস্থায় ফোন করছে। হিগিন্স। জর্জ হিগিন্স।
আপনার ডায়রির জি?
ইয়েস। বলে কী—সেদিন টেলিফোনে আমি অত্যন্ত বাকার মতো কথা বলেছি। যখন তোমার কাছে ট্রিটমেন্টের জন্য যাই, তখন আমার যে ব্যবসা ছিল, এখনও সেই ব্যবসাই রয়েছে। একচেটিয়া ব্যবসা আমার, সুতরাং জি থেকে অনেকেই আমার আসল পরিচয় অনুমান করতে পারবে। সে কাট মি আউট। মাতালকে তো আর যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝানো যায় না। ফলে ফোন রেখে দিতে হল। বুঝতেই পারছেন, আমি রুগি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে এদের বাড়ি গিয়ে সামনাসামনি কথা বলে যে কিছু বোঝাব তার সময় বা সামর্থ্য আমার নেই। এ কাজের ভারটা আমি আপনাকে দিতে চাই। এ এবং জি। আর-কে নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কারণ তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে নামের আদ্যক্ষর থেকে তাকে কেউ চিনে ফেলবে এ আশঙ্কা তার নেই।
কিন্তু এই তিনজনের আসল পরিচয়টা—!
কাগজ পেনসিল আছে? ফেলুদা পকেট থেকে নোটবুক আর ডট পেন বার করল।
লিখুন, এ হল অরুণ সেনগুপ্ত। ম্যাকনিল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার, রোটারি ক্লাবের ভাইস প্রসিডোন্ট। বাসস্থান এগারো নম্বর রোল্যান্ড রোড। ফোন নম্বর ডিরেক্টরিতে দেখে নেবেন।
ফেলুদা চটপট ব্যাপারটা লিখে নিল।
এবার লিখুন, বলে চললেন ডাঃ মুনসী, জি হল জর্জ হিগিন্স। টেলিভিশনের জন্য বিদেশে জনোয়ার চালান দেবার ব্যবসা এঁর। বাড়ির নম্বর নব্ববুই রিপন স্ট্রিট। রাস্তার নাম থেকে বুঝতে পারবেন। উনি পুরো সাহেব নন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তৃতীয় ব্যক্তির আসল পরিচয় প্রয়োজন হলে দেব, নচেৎ নয়।