আমি আবার জিজ্ঞাসা করছি—সে পার্ল কোথায় আছে?
আমার কাছে।
ওটা আমার দরকার।
যা দরকার তা কি সব সময়ে পাওয়া যায়?
মগনলাল মেঘরাজ ক্যান অলওয়েজ গেট ইট। কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, মিস্টার মিটার। আমার ওই পিংক পার্ল চাই। না হলে, আপনি তো জানেন, আমি যেমন করে হাক। ওটা আদায় করে নেব।
তা হলে সেটাই করুন, কারণ মুক্তো আমি আপনাকে দিচ্ছি না।
দেবেন না?
ভদ্রলোকের এক কথা।
তা হলে আমি আসি। মগনলাল উঠে পড়লেন। গুডবাই, আঙ্কল।
গুডবাই, ক্ষীণস্বরে বললেন জটায়ু।
দরজার কাছে গিয়ে মগনলাল নেমে ফেলুদার দিকে ঘুরলেন। তারপর বললেন, আমি তিন দিন সময় দিচ্ছি। আপনাকে। আজ সোমবার। সোম, মঙ্গল, বুধ। বুঝেছেন?
বুঝেছি।
মগনলাল বেরিয়ে গেলেন। লালমোহনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না মোটেই। দিয়ে দিন মশাই, দিয়ে দিন। আর আপনি কাছেই বা আর কত দিন রাখতে পারবেন। বড়ালকে তো তাঁর জিনিস ফেরত দিতে হবে—তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এত সাধের জিনিস।
যিদিন মুক্তো বেহাত হবার আশঙ্কা আছে ততদিন এটা বড়ালকে ফেরত দেওয়া যাবে না। সব সংশয় কাটিয়ে উঠলে পর যেখানের মুক্তো সেখানে যাবে।
কিন্তু বড়াল যে এক মহারাজার কথা বলছিল তার সম্বন্ধেও তো একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।
সে খোঁজ দিতে পারেন সিধুজ্যাঠা। বহুদিন জ্যাঠার সঙ্গে দেখা হয়নি। চলুন। একবার ঘুরে আসি।
জায়গার নামটা মনে আছে?
ধরমপুর।
অরি মহারাজার নাম?
সূরয সিং।
আমরা লালমোহনবাবুর গাড়িতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিধু জ্যাঠার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। জ্যাঠা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে একটা পুরনো পুঁথি পরীক্ষা করছিলেন, আমাদের দেখে গভীর হয়ে গেলেন।
তোমরা কে? তোমাদের তো আমি চিনি না।
ফেলুদা হেসে বলল, অপরাধ নেবেন না জ্যাঠা। পসারটা একটু বেড়েছে বলে আর লোকজনের বাড়িতে বিশেষ যাওয়া হয় না। আমি যে কাজে উন্নতি করছি তাতে আপনি নিশ্চয়ই খুশি।
এবার সিধুজ্যাঠার মুখে হাসি ফুটল।
ফেলুমিত্তির—তোমাকে কি আমি আজ থেকে চিনি? আট বছর বয়সে এয়ার গান দিয়ে শালিক মেরে এনে আমায় দেখিয়েছিলে। আমি বলেছিলাম নিরীহ জীবকে আর কক্ষনও মারবে না—কথা দাও। তুমি সেদিন থেকে পাখি মারা বন্ধ করেছিলে। গোয়েন্দাগিরিতে পসার হচ্ছে বলে আমার কাছে বড়াই কোরো না। গোয়েন্দা আমিও হতে পারতাম। তার সব গুণই আমার ছিল। এখনও আছে। তবে কোনওরকম কাজে বাঁধা পড়া আমার ধাতে সয় না। আমার সময় যদি আমি নিজে ইচ্ছামতো ব্যয় না করতে পারি তা হলো লাভটা কী? শার্লক হামসের এক দাদা ছিল জানতে? মাইক্রফট হোমস। জাত কুঁড়ে, কিন্তু বুদ্ধিতে সত্যিই শার্লকের দাদা। সেই দাদার কাছে শার্লক মাঝে মাঝে যেত। পরামর্শ নিতে। আমি হচ্ছি। সেই মাইক্ৰফুট। যাক গে, এখন বলো কী জন্যে আগমন?
একজন লোক সম্বন্ধে আপনার কাছে কোনও ইনফরমেশন আছে কি না জানতে এসেছিলাম।
কে সেই ব্যক্তি?
আপনি ধরমপুরের নাম শুনেছেন?
শুনব না কেন? উত্তরপ্রদেশের একটা করদ রাজ্য ছিল। আলিগড় থেকে সাতত্তর মাইল দক্ষিণে। ট্রেন নেই, গাড়িতে যেতে হয়।
তা হলে সূর্য সিং-এর সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই জানেন? ওরে বাবা। —সে কি এখনও বেঁচে আছে?
হ্যাঁ।
সে যে একটি আস্ত বাঘ। মালটি মিলিওনেয়ার। হোটেলের ব্যবসার টাকা। হিরে জহরতের অত ভাল কালেকশন ভারতবর্ষে আর কারুর নেই।
লোক কেমন জানেন?
তা কী করে জানিব? সে কি আমার এই কুটিরে পদার্পণ করেছে, না। আমি তার বাড়ি গেছি? এ সব লোককে ভাল-খারাপ বলে বর্ণনা করা যায় না। তুমি হয়তে গিয়ে দেখলে তার মতো অতিথিবৎসল লোক আর হয় না—তোমাকে রাজার হালে রেখে দিল। আবার পরদিন হয়তো সেই লোকই তার কালেকশনের জন্য পাথর আদায় করতে একজনকে খুনই করে ফেলল। অবশ্য নিজে হাতে নয়; এরা সব সময় আইন বাঁচিয়ে চলে, যদিও তার জন্য ট্যাঁক খরচা হয়। অনেক।
এই খবরই যথেষ্ট বলে আমরা সিধুজ্যাঠাকে আর বিরক্ত করলাম না, যদিও সূর্য সিং-এর সঙ্গে আমাদের কারবার হচ্ছে কীভাবে সেটা এখনও বুঝতে পারলাম না। ফেলুদাকে বলতে ও বলল, তাও এ খবরগুলো জেনে রাখা ভাল। সে লোক যখন বড়ালকে চিঠি লিখেছে। তখনই বোঝা যাচ্ছে তার মুক্তোটার বিশেষ দরকার। সেটা পাবার জন্য সে কতদূর যেতে পারে। সেইটে দেখার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে।
০৬. বিস্ফোরণটা হল শুক্রবার
মগনলাল বিষ্যুদবার পর্যন্ত টাইম দিয়েছিল ফেলুদা তার মধ্যে ওর সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করল না। আর বিস্ফোরণটা হল শুক্রবার সকালে।
আমিও ফেলুদার দেখাদেখি রোজ সকালে যোগব্যায়াম করি। সাড়ে ছাঁটায় সে ব্যাপার শেষ হয়েছে। ফেলুদার কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না দেখে আমি তার ঘরের দিকে গেলাম। দরজাটা ভেজানা ছিল। ঠেলে খুলতেই একটা দৃশ্য দেখে থ মেরে গেলাম।
ফেলুদা এখনও ঘুমোচ্ছে। এ যে অভাবনীয় ব্যাপার! এই সময়ের মধ্যে ফেলুদার স্নান ব্যায়াম দাড়ি কামানো সব শেষ হয়ে যায়। সে বসবার ঘরে খবরের কাগজ পড়ে। আজ কী হল?
আমি ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলাম। বার দু-এক ঠেলা দিয়ে আর নাম ধরে ডেকে বুঝতে পারলাম ওর হুঁশ নেই।
আমার দৃষ্টি গোদরেজের আলমারির দিকে চলে গেল। দরজা হাট হয়ে আছে। সামনে মেঝেতে জিনিসপত্র ছড়ানো।
ফেলুদার পালস দেখলাম। দিব্যি চলছে। দৌড়ে বসবার ঘরে গিয়ে আমাদের ডাক্তার ভৌমিককে টেলিফোন করে ব্যাপারটা বললাম। ভদ্রলোক দশ মিনিটের মধ্যে চলে এলেন।