কিছুই না, সলজ্জ হাসি হেসে বললেন জয়চাঁদবাবু, আমাদের ফ্যামিলি সংক্রান্ত একটা ব্যাপার।
লালমোহনবাবু আগ্রহের সঙ্গে একটু এগিয়ে বসলেন। কী ব্যাপার, কী ব্যাপার?-গল্পের গন্ধ পেলেই ভদ্রলোক চনমনিয়ে ওঠেন।
জয়চাঁদবাবু হাত থেকে সরবতের গেলাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, আমি নিজে এখন ইস্কুল মাস্টারি করি, কিন্তু আমার পৈতৃক ব্যবসা ছিল হিরে-জহরতের। কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে আমাদের একটা গয়নার দোকান এখনও আছে; সেটা দেখেন আমার এক কাকা। আমি যাঁর কথা বলছি তিনি ছিলেন আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদা-নাম ছিল। অভয়চরণ বড়াল। তিনিই এই ব্যবসা আরম্ভ করেন। জাহাজে করে ভারতবর্ষের উপকূলে সব শহরে গিয়ে হিরে পান্না কেনাবেচা করতেন। মাদ্রাজের কাছাকাছি কোনও একটা শহরে তিনি একবার একটা রত্ন, পান। সেটা তিনি যত্ন করে জমিয়ে রেখেছিলেন। সে ব্রত্ন এখনও আমার কাছে রয়েছে। সেটা আমি আপনাদের দেখাতে চাই।
সঙ্গে এনেছেন? জটায়ু প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা খয়েরি রঙের রুমাল বার করলেন, তাতে গেরো দিয়ে বাঁধা একটা ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্স। বাক্স খুলে তার থেকে একটা মুক্তো বার করে ভদ্রলোক আমাদের সামনে ধরলেন।
ফেলুদা উত্তেজনায় ভরা চাপা স্বরে বলে উঠল—
একী-এ যে পিংক পার্ল!
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন জয়চাঁদ বড়াল। অবিশ্যি গোলাপী হওয়ায় এর কোনও বিশেষত্ব আছে কি না জানি না।
কী বলছেন আপনি! বলল ফেলুদা। ভারতবর্ষে যতরকম মুক্তো পাওয়া যায় তার মধ্যে সবচেয়ে দুপ্রাপ্য আর সবচেয়ে মূল্যবান হল গোলাপী মুক্তো।
মুক্তো সাদা ছাড়া হয় তাই তো জানতাম না, বললেন লালমোহনবাবু।
সাদা লাল কালো হলদে নীল-সবরকম হয়, বলল ফেলুদা। তারপর জয়চাঁদবাবুর দিকে চেয়ে বলল, শুনুন-আপনি ও জিনিস ওভাবে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন না। বাড়িতে সিন্দুক থাকলে তাতে রেখে দেবেন।
আজ্ঞে এটা আমি বার করি না বললেই চলে। আজ। আপনাকে দেখাব বলে নিয়ে এলাম।
আর কাকে দেখিয়েছেন ওটা?
মাত্র একজন। গত সপ্তাহে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বণিকদের নিয়ে একটা বই লিখছেন-তাঁকে দেখিয়েছিলাম।
এ ছাড়া আর কেউ জানে না তো?
কী আর বলব বলুন—এই ভদ্রলোক, যিনি বই লিখছেন—তিনি আবার ঘটনাটা এক সাংবাদিককে বলেন। ফলে পরদিনই সেটা কাগজে বেরিয়ে যায়।
কলকাতার কাগজে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনটে বাংলা কাগজে বেরিয়েছে। আপনি ফিরে গিয়ে সেটা দেখতে পাবেন।
গোলাপী মুক্তো বলে বলা আছে তাতে?
তাই তো বলেছে। একটা কাগজে তো এ-ও বলে দিয়েছে যে মুক্তোর মধ্যে গোলাপী মুক্তোই সবচেয়ে ভ্যালুয়েবল।
সর্বনাশ! কপালে হাত ঠুকে বললে ফেলুদা। আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলছি। এ জিনিস আপনি কাউকে কখনও দেখাবেন না। এই একটা মুক্তোর দাম কত তা আপনি কল্পনা করতে পারেন? বিক্রি করলে আপনি যা দাম পাবেন তাতে আপনার পরের দুই পুরুষ পর্যন্ত খাওয়া-পরার কোনও ভাবনা থাকবে না।
এটা আপনি আমাকে বলে খুব উপকার করলেন।
আমরা তিনজনেই একবার করে মুক্তোটা হাতে নিয়ে দেখলাম। নিটাল চেহারা। ফেলুদা বলল যে, শেপের দিক দিয়েও মুক্তোটা অসাধারণ।
জয়চাঁদবাবু তাঁর সম্পত্তি আবার পকেটে পুরে নিলেন। ফেলুদা ছিক করে একটা আক্ষেপসূচক শব্দ করে বলল, খবরটা কাগজে বেরোনো খুবই আনফরচুনেট ব্যাপার। আশা করি কোনও গোলমাল হবে না।
যদি হয় তা হলে কি আমি আপনাকে জানাব?
নিশ্চয়ই। আমার ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই সোমেশ্বর জানে। আপনি বিনা দ্বিধায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এমনকী দরকার হলে ওটাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে পারেন।
০৩. হাওড়া এক্সপ্রেস
আমরা পরদিন সকালে হাওড়া এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে বিকেলে কলকাতা পৌঁছে গেলাম। আমাদের সঙ্গে হালদারমশাইও ফিরলেন। দেখলাম ফেলুদা ওঁর সামনে একবারও গোলাপী মুক্তোর উল্লেখ করল না।
বাড়িতে এসে ফেলুদা শুধু একটা কথাই বলল।
মুক্তোর খবরটা কাগজে বেরোনোটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।
আসবার তিন দিন পরে সকালে বসবার ঘরে বসে কথাসরিৎসাগর পড়ছি, ফেলুদা ক্লিপ দিয়ে নখ কাটছে, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফেলুদা উঠে। ধরল। কথা শেষ হয়ে যাবার পর ফেলুদা বলল, বড়াল।
কলকাতায় এসেছেন?
হ্যাঁ। আমার সঙ্গে বিশেষ দরকার। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আসছে। কথা শুনেই বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক খুবই উত্তেজিত।
আমরা ফোন করে লালমোহনবাবুকে ডাকিয়ে নিলাম! কোনও মামলার কোনও জরুরি অংশ থেকে বাদ পড়লে উনি বিশেষ ক্ষুন্ন হন। বলেন, কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারি না। ফলে চিস্ত করে যে আপনাকে হেলপ করব তারও উপায় থাকে না।
ভদ্রলোক ঠিক পাঁচটায় এসে পড়লেন, আর তার আধঘণ্টা পরে, শ্ৰীনাথ চা দেবার সঙ্গে সঙ্গে, এসে পড়লেন জয়চাঁদ বড়াল।
এ চেহারাই আলাদা! এই তিন দিনে ভদ্রলোকের উপর দিয়ে যে বেশ ধকল গেছে সেটা বাঝাই যায়। ইতিমধ্যে দুটো ইংরেজি কাগজেও পিংক পার্লের খবরটা বেরিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
জয়চাঁদবাবু এক গেলাস জল খেয়ে আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়িয়ে বললেন, একটা খবরের কাগজের খবর থেকে যে এত কিছু ঘটতে পারে এ আমার ধারণা ছিল না। তিনটে ঘটনা আপনাকে বলার আছে। এক হচ্ছে আমার এক খুড়তুতো ভাই-নাম হচ্ছে মতিলাল বড়াল। –তার একটা চিঠি। সে বহুকাল থেকে বেনারসে আছে। একটা সিনেমা হাউস চালায়। সে লিখেছে যে যদি আমি মুক্তোগটা বিক্রি করি তা হলে যা পাৰ তার একটা অংশ তাকে দিতে হবে। মুক্তোটা পরিবারের সম্পত্তি, শুধু আমার একার নয়। চিঠিতে স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে মুক্তোর ব্যাপারটা আমি তার কাছ থেকে গোপন করে গেছি।