আবহাওয়াটা যে কলকাতার তুলনায় নির্মল সেটা এর মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে, বললেন লালমোহনবাবু।
আমিও সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। তা ছাড়া কানটাও আরাম পাচ্ছে। ট্রাফিক বলে কোনও ব্যাপার নেই; এখনও পর্যন্ত একটাও হর্ন শুনিনি।
একজন বেয়ারা একটা থালায় তিন গেলাস সরবত দিয়ে গেল। সেই সরবত খেতে না। খেতেই খবর এল যে নীচে খাবার ঘরে পাত পড়েছে।
০২. আতিথেয়তায় মল্লিকমশাই পয়লা নম্বর
আতিথেয়তায় মল্লিকমশাই যে একেবারে পয়লা নম্বর সেটা খাবার বহর দেখেই বোঝা গেল। মাছের যে এতরকম জিনিস রান্না হতে পারে সেটা আমার ধারণাই ছিল না। ফেলুদা অল্প খায়, কিন্তু লালমোহনবাবু ভোজনরসিক—খুব তৃপ্তি করে খেলেন। ওঁর খুশির আরেকটা কারণ হচ্ছে যে পঞ্চাননবাবু ওঁর লেখা সম্বন্ধে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করছিলেন তাই ভদ্রলোক নিজের ঢাক পেটাবার একটা সুযোগ পেলেন।
খাবার পর মল্লিকমশাই বললেন, এবার আপনাদের একটু এনটারটেন করব। চলুন আমার সংগ্রহের কিছু জিনিস দেখাই।
আমরা আবার দোতলায় ফিরে এলাম। এবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে না ঘুরে বাঁ দিকে ঘুরলাম। এদিকেই পঞ্চাননবাবুর ঘর আর তাঁর সংগ্রহশালা।
জিনিসপত্র অনেকরকম জোগাড় করেছেন। ভদ্রলোক তাতে সন্দেহ নেই। তার প্ৰত্যেকটারই আবার একটা করে পরিচয় আছে। মহর্ষির নাগরাটা প্রথমেই দেখা হল, তারপর ক্রমে টিপুর নস্যির কৌটো, ক্লাইভের ট্যাঁকঘড়ি, সিরাজদ্দৌলার রুমাল, রানি রাসমণির পানবাটা-এ সবই দেখলাম। আমরা সকলেই অবিশ্যি খুবই তারিফ করলাম, কিন্তু আমার যেন কেমন-কেমন লাগিছিল। কোন জিনিসটা কার ছিল সেটা জানা গেল কী করে? ক্লাইভের ঘড়িতে তো আর ক্লাইভের নাম লেখা নেই। বা সিরাজদ্দৌলার রুমালেও নেই।
সব দেখেটেখে চারজনে ঘরে ফেরার পথে নবজীবনবাবু ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন মনে হল?
ফেলুদা বলল, খুব কনভিনসিং লাগল না। কনভিনসিং? ওর মধ্যে একটা জিনিসও জেনুইন নেই। লোকটা বাগাস, হামবাগ। মহর্ষির নাগরা থেকে তো রীতিমতো নতুন চামড়ার গন্ধ বেরোচ্ছিল।
ঘণ্টা তিনেক বিশ্রামের সময় ছিল, তারপর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। ফেলুদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিল বোধহয় আজ দশ বছর পর। ওকে পোশাকটা যে দারুণ মানায় সেটা স্বীকার করতেই হয়। লালমোহনবাবু একটা নকশাদার কাশ্মীরি শাল চাপিয়েছিলেন, বললেন সেটা ওঁর ঠাকুরদাদার ছিল।
ঠিক পৌনে ছটায় বেয়ারা পাঠিয়ে আমাদের ডেকে নিলেন পঞ্চাননবাবু। শীতকাল, তাই এর মধ্যেই বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে! অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে দেখি আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। স্পটলাইট, ফুয়ারেসেন্ট লাইট, রঙিন বালব—কিছুরই অভাব নেই।
আমরা মঞ্চে গিয়ে বসলাম! সংবর্ধনার ব্যাপারটা একেবারে শেষে—অর্থাৎ ক্লাইম্যাক্স। তার আগে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটকের অংশের দৃশ্য–সবই হল। সকলেই আজ জান দিয়ে দিচ্ছে ফেলুদাকে ইমপ্রেস করার জন্য, ফেলুদাও হাততালিতে কার্পণ্য করছে না।
সংবর্ধনার ব্যাপারটা কুড়ি মিনিটে সারা হয়ে গেল! সময় একটু লাগল। মানপত্রটা পড়তে। এটা বলতেই হবে যে মানপত্র দুটো দেখতে বেশ ভাল হয়েছে, আর যে লিখেছে। তার হাতের লেখা খুব ভাল। সব শেষে কয়েকজন সাংবাদিক ফেলুদাকে ঘিরে ধরল, আর তাদের কিছু প্রশ্নের জবাবও দিতে হল ফেলুদাকে। সে বলল এখন তার অবসর—হাতে কোনও কেস নেই।
নবজীবনবাবু অনুষ্ঠানের শেষে পঞ্চাননবাবুর সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেলেন, আমরা রয়ে গেলাম কারণ আমাদের নেমন্তান্ন আছে ফেলুদার সহপাঠী সোমেশ্বর সাহার বাড়িতে। ভিড় কমবার পরেই ভদ্রলোক হাসিমুখে ফেলুদার দিকে এগিয়ে এলেন।
চিনতে পারছিস?
অনায়াসে, বলল ফেলুদা। গোঁফটা ছাড়া আর প্রায় কিছুই বদলায়নি।
তুইও মোটামুটি একই রকম আছিস, তবে চোখে একটা দীপ্তি দেখছি যেটা বুদ্ধি পাকবার ফলে হয়েছে। কটা কেস হ্যান্ডল করলি এ পর্যন্ত?
হিসেব নেই, বলল ফেলুদা। গোড়ার দিকে হিসেব রাখতাম, আজকাল ছেড়ে দিয়েছি।
তোর সঙ্গে একজন আলাপ করতে ভীষণ আগ্রহী—সোমেশ্বর সাহা তাঁর পিছনে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোককে পিঠে হাত দিয়ে সামনে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। —এঁর নাম জয়চাঁদ বড়াল। এখানকারই বাসিন্দা। ইনিই মানপত্রটা ডিজাইন করেছেন।
তাই বুঝি? বলল ফেলুদা। খুব ভাল হয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম।
জয়চাঁদবাবু লজ্জায় ঘাড় নিচু করে বললেন, আপনার কাছ থেকে প্রশংসা পাব। এ কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত।
আজি ইনিও আমাদের বাড়িতেই খাচ্ছেন, বললেন সোমেশ্বরবাবু। চ—এখানে দাঁড়িয়ে থেকে গেজিয়ে কোনও লাভ নেই। আমার বাড়ি বেশি দূর নয়। মিনিট দশেক পা চালাতে পারবি তো?
জরুর।
সোমেশ্বরবাবুর বাড়ি বড় না হলেও, বেশ গুছানো। সেটা বোধহয় ওঁর স্ত্রীর জন্য। স্ত্রী ছাড়া একটি দশ বছরের ছেলেও আছে ভদ্রলোকের। জয়চাঁদবাবু সমেত আমরা চারজনে বৈঠকখানায় বসার দশ মিনিটের মধ্যেই সরবত এসে গেল। স্ত্রী উমাদেবী বললেন, আগে সরবীতটা খান-সাড়ে নটার মধ্যে আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করে দেব।
মিনিট পাঁচেক এটা-সেটা নিয়ে কথা হবার পর সোমেশ্বরবাবু জয়চাঁদ বড়ালকে দেখিয়ে বললেন, এঁর একটা বিশেষ কিছু বলার আছে তোকে। আমার মনে হয় তুই ইন্টারেস্ট পাবি।
বটে? বলল ফেলুদা। কী ব্যাপার শুনি।