ফেলুদা পকেট থেকে ভেলভোটের কৌটোটা বার করে সূর্য সিংকে দিল। কেঁটাটা থেকে মুক্তোটা বার করে ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে ধরে সেটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকলেন সূর্য সিং। তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করছে।
আমি এটাকে যাচাই করে নিলে আশা করি তোমার আপত্তি হবে না। এতগুলো টাকা…
ঠিক আছে।
শঙ্করপ্রসাদ! হাঁক দিলেন সূর্য সিং। পাশের ঘর থেকে একজন ফিটফট। ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, বছর চল্লিশোক বয়স, চোখে সোনার চশমা!
স্যার?
একবার দেখো তো এই মুক্তোটা জেনুইন কি না।
শঙ্করপ্রসাদ মিনিটখানেক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেই সেটা সূর্য সিংকে ফেরত দিল।
নো স্যার।
মানে?
এটা ফল্স। সস্তা সাদা কালচারড পার্লের উপর গোলাপী রং করে দেওয়া হয়েছে।
আর ইউ শিওর?
অ্যাবসোলিউটলি।
সূরয সিং-এর মুখ লাল। কাঁপতে কাঁপতে ফেলুদার দিকে চাইলেন। তাঁর কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।
ইউ-ইউ–মেকি জিনিস আমাকে পাচার করছিলে?
ফেলুদার মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
তা হলে বড়ালের বাড়িতেই নিশ্চয়ই ফল্স মুক্তো ছিল, বলল ফেলুদা।
তোমার রিভলভার নামাও।
ফেলুদা নামাল।
এই নাও তোমার ঝুঠা। মোতি।
ফেলুদা বাক্সসমেত মুক্তোটা সূর্য সিং-এর হাত থেকে নিল।
নিউ গেট আউট।
আমরা তিনজন সুবোধ বালকের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। যখন লিফ্টে উঠছি তখন দেখলাম ফেলুদার কপালে গভীর খাঁজ।
কলকাতা ফেরার পথে ট্রেনে ফেলুদা একটা কথাও বলল না। এমন অবস্থায় যে সে কোনওদিন পড়েনি সেটা আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি।
আমরা ফিরলাম রাত্রে। পরদিন সকলে আমার ঘর থেকে শুনতে পেলাম ফেলুদা গুন গুন করে গান গাইছে।
আমি বসবার ঘরে এসে দেখি ও পায়চারি করছে আর আলোকের এই বর্ণাধারায়-এর সুরাটা ভাঁজছে। আমাকে দেখেও সে পায়চারি, গান কোনওটাই থামল না। আমি অবশ্য খুশি। ফেলুদাকে মনমরা দেখতে আমার মোটেও ভাল লাগে না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লালমোহনবাবুর গাড়ির হর্ন শোনা গেল। আমি দরজাটা খুলে দিলাম, ভদ্রলোক ঢুকলেন।
প্ৰাতঃ প্ৰণাম! ঘাড় হেঁট করে হাতজোড় করে বলল ফেলুদা। আসতে আজ্ঞা হাক। লালমোহনবাবু কেমন যেন থতমত খেয়ে একটা বাকা হাসি হেসে বললেন, আপনি কি তা হলে…?
আমি অন্ধকার পছন্দ করি না, লালমোহনবাবু, তাই সেখানে আমাকে বেশিক্ষণ ফেলে। রাখা চলে না। ফলস মুক্তোটা যে আপনার গড়পারের সেক্রা বন্ধুর কীর্তি সেটা আমি বুঝেছি, আর এটা যে আপনার এবং আমার ভ্রাতার যৌথ প্ৰয়াস সেটা বুঝেছি, কিন্তু কবে। কখন–
বলছি, স্যার, বলছি, বললেন লালমোহনবাবু। অপরাধ নেবেন না। কাইন্ডলি। আর আপনার ভাইটিকেও মাপ করে দেবেন। আপনি মগনলালের হুমকি যেরকম বেপরোয়া ভাবে নিলেন, তাতে আমি অত্যন্ত উদ্বেগ বোধ করছিলুম। ও মুক্তোটা পেয়ে যাবে এই চিন্তাটাই আমি বরদাস্ত করতে পারছিলুম না। ও তিন দিন সময় দিয়েছিল সোম, মঙ্গল, বুধ। মঙ্গলবার আমি সকলে আসি। আপনি চুল ছাটাতে গেলেন, মনে আছে তো? সেই সময় তপেশ আপনার চাবি দিয়ে আলমারি খুলে মুক্তোটা বার করে আমায় দেয়। এক দিনেই ডুপ্লিকেট হয়ে যায়। বুধবার ওটা তপেশকে এনে দিই, ও সুযোগ বুঝে সেটা আলমারিতে রেখে দেয়। যা করেছি তা শুধু আপনার মঙ্গলের জন্য, বিশ্বাস করুন।
আপনাদের ফন্দি অবিশ্যি তারিফ করার মতোই।
আপনি সেদিন যখন মগনলালকে বললেন মুক্তোটা ফলস, তখন আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাদের কারসাজি ধরে ফেলেছেন।
না ধরিনি। আপনাদের পক্ষে এতটা মাথা খাটানো সম্ভব সেটা ভাবতে পারিনি। আসলে আপনারা যে ফেলুমিত্তিরের এত কাছে থাকেন সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।
জয়চাঁদবাবু নিশ্চয়ই আরও ভাল অফার পাবেন।
অলরেডি পেয়েছেন। কাল এসে সোমেশ্বরের একটা চিঠিতে জানলাম। এক আমেরিকান ভদ্রলোক। এক লাখ পঁচিশ অফার করেছেন।
বাঃ, এ তো সত্যিই সুখবর।
ফেলুদা এবার আমার দিকে ফিরল। আমি একটা গাঁটা কি রুদা এক্সপেক্ট করছিলাম, তার বদলে ও আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তোকে একটা অ্যাডভাইস দিই। এই ঘটনাটার বিষয় যখন লিখবি, তখন তোদের এই কীর্তিটার কথা একেবারে শেষে প্ৰকাশ করবি। নইলে গল্প জমবে না।
আমি অবিশ্যি তাই করেছি। লোকে আশা করি আমার এই কারচুপিটা মাইন্ড করবে না। তা হলে এবার আসলটা আপনাকে দিয়ে দিই? বললেন লালমোহনবাবু।
ইয়েস, ইফ ইউ প্লিজ, মিস্টার গাঙ্গুলী।
জটায়ু পকেট থেকে লাল ভেলভেটের কৌটোটা বার করে ফেলুদাকে দিল। ফেলুদা বাক্সটা খুলে জানালার কাছে গিয়ে আলোতে ধরল।
গোলাপী মুক্ত সগৌরবে বিরাজমান।