অবশেষে লালমোহনবাবু হয়তা আর থাকতে না পেরে ফিসফিস করে বললেন, ওই গুণ্ডাদের সঙ্গে তোমার দাদার যাবার কী দরকার ছিল বুঝতে পারলাম না।
সেটা যথাসময়ে বুঝবেন।
আমার ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। ঠিক আছে।
আমার মনে হয় কথা না বলাই ভাল। ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। খুব মন দিয়ে শুনলে দূর থেকে হারমোনিয়াম আর ঘুঙুরের শব্দ পাওয়া যায়। আকাশের দিকে চাইলাম। এত তারা কলকাতার আকাশে কোনওদিন দেখিনি। এই তারার আলোতেই চার পাশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। যতদূর মনে হয়, আজ অমাবস্যা।
বেশি সময় যায়নি, কিন্তু এখনই মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ হল? দিশ মিনিট? পনেরো মিনিট? আশ্চর্য! মগনলালের বাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে, এখান থেকে ত্ৰিশ হাত দূরে, কিন্তু তার কোনও শব্দ নেই।
আরও মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর পায়ের শব্দ পেলাম। একজনের বেশি লোক। এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
ফেলুদারাই ফিরছে। কাছে এসে বলল, চ।
কাজ হল? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
খতম, বলল ফেলুদা! তারপর মতিলালবাবুর দিকে ফিরে বলল, অনেক ধন্যবাদ। আপনার শেয়ারের ব্যবস্থা আমি করে দেব।
আমরা আমাদের হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম।
কথা হল একেবারে ঘরে ঢুকে।
কিছু বলুন, মশাই। আর থাকতে না পেরে বললেন লালমোহনবাবু।
আগে এইটে দেখুন।
ফেলুদা পকেট থেকে লাল ভেলভেটের বাক্সটা বার করে খাটের উপর রাখল।
সাবাস বললেন লালমোহনবাবু। কিন্তু কীভাবে হল ব্যাপারটা একটু বলুন। খুন-খারাপি হয়নি তো?
সেই পালোয়ানটা মাথায় একটু চোট পেয়েছে, সেটা মনোহরের কীর্তি।
কিন্তু ক্যাশবাক্স খুললেন কী করে?
যে ভাবে লোকে খোলে। চাবি দিয়ে।
এ, কি ম্যাজিক নাকি?
নো স্যার। মেডিসিন।
মানে?
সাপলাইড বাই নিরঞ্জনবাবুর বন্ধু ডাক্তার চৌধুরী।
কী সব বলছেন আবোল তাবোলা? কীসের সাপলাই?
ক্লোরোফর্ম বলল ফেলুদা। শঠে শাঠ্যম্। এবার বুঝেছেন?
পরদিন রাত সোয়া এগারোটায় দিল্লি এক্সপ্রেস ধরে তারপর দিন ভোর ছটায় দিল্লি পৌঁছলাম। এর আগের বার আমরা জনপথ হোটেলে ছিলাম, এবারও তাই রইলাম। ফেলুদা ঘরে এসে আর কিছু করার আগে বিভিন্ন হোটেলে ফোন করে খোঁজ নিতে আরম্ভ করল। সূর্য সিং কোথায় আছে। দশ মিনিট চেষ্টা করার পর তাজ হোটেলে বলল, হ্যাঁ, সূর্য সিং এখানেই আছেন। রুম থ্রি ফোর সেভ্ন।
একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি কি? সৌভাগ্যক্রমে সূরয সিং তাঁর ঘরেই ছিলেন। এক মিনিটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেল। সন্ধ্যা ছটা। হোটেলে ওঁর ঘরেই যেতে হবে। কী কারণ জিজ্ঞেস করেছিল, বলল ফেলুদা। আমি তাকে পিংক পার্ল সংক্রান্ত ব্যাপার বলতে তৎক্ষণাৎ টাইম দিয়ে দিল।
দুপুর বেলাটা কিছু করার নেই। জনপথে একটা চিনে রেস্টোরান্টে খেয়ে দোকানগুলো দেখে তিনটে নাগাত হোটেলে ফিরে এলাম একটু বিশ্রামের জন্য। পৌনে ছটায় বেরোতে হবে। লালমোহনবাবু ফেলুদাকে মনে করিয়ে দিলেন, আপনার ইয়েটা নিতে ভুলবেন না।
ছটায় তাজে পৌঁছে ফেলুদা প্রথমে নীচ থেকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে আমরা এসেছি।
আমার ঘরে চলে আসুন, বললেন ভদ্রলোক।
তিনশো সাতচল্লিশে গিয়ে বেল টিপতে যে দরজা খুলল তাকে মনে হল সেক্রেটারি জাতীয় কেউ। বললেন, আপনারা বসুন, উনি এক্ষুনি আসছেন।
ঘর বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়; তিনটে ঘর জুড়ে একটা বিশাল সুইট। যেটায় ঢুকেছি সেটা সিটিং রুম। আমরা সোফায় গিয়ে বসলাম।
মিনিট পাঁচেক বসতেই ভদ্রলোক এসে পড়লেন।
ইনি যে অত্যন্ত ধনী সেটা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। গায়ে চাস্ত সুট, সোনার টাইপিন, পকেটে সোনার কলম। হাতে পাথর বসানো সোনার আংটি। বয়স পঞ্চান্নর বেশি। নয়। কনের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে, বাকি চুল কালো, আর চাড়া দেওয়া গোঁফটাও কালো।
হু ইজ মিস্টার মিটার?
ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে পরিচয় দেওয়ার ব্যাপারটা সেরে নিল। ভদ্রলোক দেখলাম দাঁড়িয়েই রইলেন।
আপনার সঙ্গে পিংক পার্লের কী কানেকশন? ফেলুদাকে প্রশ্ন করলেন মিস্টার সিং।
ফেলুদা বলল, আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। জয়চাঁদ বড়াল মুক্তোটা আমার জিন্মায় রেখেছেন যাতে ওটা নিরাপদ থাকে।
কথাটা আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য। নই, মিস্টার মিটার। আপনি মালিকের কাছ থেকে যে মুক্তোটা চুরি করেননি তার কী প্রমাণ?
কোনও প্রমাণ নেই। আপনাকে আমার কথা মেনে নিতে হবে।
আমি তাতে রাজি নই।
তা হলে আমার একটা কথাই বলার আছে—আমি মুক্তোটা দেব না। এটা যার জিনিস তাঁর কাছে ফেরত চলে যাবে।
মুক্তোটা দিতে আপনি বাধ্য।
না মিস্টার সিং, আমি বাধ্য নাই। নো ওয়ান ক্যান ফোর্স মি।
চোখের পলকে সূর্য সিং-এর হাতে একটা রিভলভার চলে এল, আর তার পরমুহূর্তেই একটা কান-ফাটানো গর্জন।
কিন্তু সেটা সূ্রয সিং-এর রিভলভার থেকে নয়, ফেলুদার কোল্ট থেকে। সে সূর্য সিং-এর হাত নামানা দেখেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। আর বিদ্যুদ্বেগে নিজের রিভলভারটা বার করেছে।
গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যয সিং-এর হাত থেকে তার রিভলভারটা ছিটকে বেরিয়ে একটা ঠং শব্দ করে ঘরের পিছন দিকের মেঝেতে পড়ল।
সূরয সিং-এর চেহারা পালটে গেছে। তার চাউনিতে ঘৃণার বদলে এখন সন্ত্ৰম।
আমি চল্লিশ গজ দূর থেকে বাঘ মেরেছি, কিন্তু তোমার মতো টিপ আমার নেই। ঠিক আছে, আমি তোমার নামেই চেক লিখে দিচ্ছি, তুমি মুক্তোটা আমাকে দাও।