এবার ফেলুদা বলল, উনি গান করেন না, মগনলালজী।
করেন না তো কী হল? এখুন করবেন। দশ মিনিট লাগবে সুন্দরলালের এখানে আসতে। সেই টাইমে টেগোর সং হবে। আঙ্কল উইল সিং। আসুন আঙ্কল—গদিপর বসুন। সোফায় বসে কি গান হয়? গেট আপ, গেট আপ! না গাইবেন তো বড় মুশকিল হবে।
আপনি বার বার ওঁকে নিয়ে এমন তামাশা করেন কেন বলুন তো? বেশ রেগে গিয়েই বলল, ফেলুদা। উনি আপনার কী ক্ষতি করেছেন?
নাথিং। দ্যাট ইজ হোয়াই আই লাইক হিম। উঠুন। আঙ্কল। উঠুন, উঠুন!
নিরুপায় হয়ে লালমোহনবাবু সোফা ছেড়ে উঠে গদিতে বসলেন।
ভেরি গুড। নাউ সিং।
আর কোনওই রাস্তা নেই। তাই ভদ্রলোক সত্যিই গান ধরলেন। আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
মগনলাল তাকিয়ায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে পাশে রাখা ক্যাশ-বাক্সের উপর তাল ঠুকে তারিফ করতে লাগলেন। এই অদ্ভুত গানের তারিফ হতে পারে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
প্রায় পাঁচ মিনিট একটানা গেয়ে লালমোহনবাবু আর পারলেন না। বললেন, বাকিটা জানি না।
দ্যাট ইজ এনাফ বললেন মগনলাল। এবার সোফায় গিয়ে বসুন।
লালমোহনবাবু সোফায় বসতেই ঘরে লোকের প্রবেশ হল—সেই পালোয়ান চাকর, আর একজন পুরু চশমাপরা বুড়ো।
আইয়ে সুন্দরলালজী, বললেন মগনলাল? আপনি এত বুঢ়টা হুয়ে গেছেন এই কবছরে তা ভাবতে পারিনি। একটা কাজের জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।
সুন্দরলাল গদিতে বসলেন। মগনলাল তাঁর ক্যাশবাক্স খুলে তার থেকে ভেলভোটের বাক্সটা বার করলেন। তারপর বাক্স থেকে মোতিটা বার করে সুন্দরলালকে প্রশ্ন করলেন, গুলাবী মোতি হয় সেটা আপনি জানেন?
গুলাবী মোতি?
হা।
সেরকম তো শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখিনি।
আপনি পঞ্চাশ বছর হল দোকান চালাচ্ছেন আর গুলাবী মোতি চোখে দেখেননি? দেখুন এইটে দেখুন। দেখে বলুন তো এটা সচ্চা না ঝুঠা?
সুন্দরলাল মুক্তোটা হাতে নিলেন। দেখলাম তাঁর হাত কাঁপছে! চোখের খুব কাছে এনে মুক্তোটাকে মিনিটখানেক ধরে দেখে সুন্দরলাল বললেন, হাঁ, এতো সত্যিই দেখছি গুলাবী মোতি। অ্যায়স কভী নেহি দেখা।
তা হলে এটা খাঁটি?
ওইসাই তো মালুম হোতা।
এবার মোতিটা দিয়ে দিন আমাকে।
সুন্দরলাল মুক্তোটা ফেরত দিয়ে দিল।
এবার আপনি যেতে পারেন।
সুন্দরলাল ঘর থেকে বেরোনোর পর মগনলাল ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, আপনি ঝুট বাত বলেছেন, মিস্টার মিটার। এই পার্ল জেনুইন।
এটা কি আপনি সূর্য সিংকে বিক্রি করতে চান?
আমি কী কবি না-করি তাতে আপনার কী?
আপনি তো এখান থেকে দিল্লি যাবেন?
হাঁ, ফাব।
ওখানে তো সূ্রয সিং রয়েছেন।
সে খবর আমি পেপারে পড়েছি।
আপনি কি বলতে চান তাঁর সঙ্গে আপনার কোনও কারবার নেই?
আমি কিছুই বলতে চাই না, মিস্টার মিটার। দ্য পিংক পার্ল চ্যাপটার ইজ ক্লোজড। আমি ওই নিয়ে আপনার সঙ্গে আর কোনও কথা বলব না।
ঠিক আছে, আমি উঠছি; আমার যে জিনিসটা আপনার কাছে রয়েছে সেটা দয়া করে ফেরত দিন।
মগনলাল আবার কলিং বেল টিপলেন। পালোয়ান এসে দাঁড়াল।
একে এর রিভলভার ওয়াপিস দিয়ে দাও।
পালোয়ান আজ্ঞা পালন করল, ফেলুদা আর আমরা দুজন উঠে পড়লাম।
মগনলালের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেমন লাগছে?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, লোকটা কী করে যে একটা মানুষের উইক পয়েন্ট ধরে ফেলে!-পাঁচ মিনিট ধরে একটানা রবীন্দ্রসংগীত জীবনে এই প্ৰথম গাইলাম।
একতলায় এসে ফেলুদা বলল, আজকে যে একটা খুব জরুরি কাজ হয়ে গেল সেটা কি বুঝতে পেরেছেন, লালমোহনবাবু?
জরুরি কাজ? ভদ্রলোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
ইয়েস স্যার, বলল ফেলুদা। জেনে গেলাম ও মুক্তোটা কোথায় রাখে।
আপনি কি ওটা আবার আদায় করার তাল করছেন?
ন্যাচারেলি।
০৯. গোলাপী মুক্তা সগৌরবে বিরাজমান
কাশীর মতো থমথমে রাত খুব কম জায়গাতেই দেখেছি। সেটা আরও বেশি মনে হয় এই জন্যে যে দিনের বেলা জায়গাটা লোকে জুনে রঙে শব্দে ভরে থাকে। আমরা বারোটার সময় যখন জ্ঞান-বাপী পৌঁছলাম তখন একটা রাস্তার কুকুরের ডাক ছাড়া কোনও শব্দ নেই।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর ফেলুদা একটা শেষ-করা চারমিনার পায়ের তলায় ফেলে চাপ দিতেই চাপা গলায় শোনা গেল, মিস্টার মিত্তির বুঝলাম মতিলাল বড়াল হাজির।
কতগুলো অন্ধকার মূর্তি আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার সঙ্গে তিনজন লোক আছে। আপনি রওনা দেবার জন্য তৈরি?
চাপা স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা হচ্ছে। ফেলুদাও সেইভাবেই বলল, নিশ্চয়ই। আর, আমাদের গাইড করতে হবে না, আমরা রাস্তা জানি।
তা হলে চলুন।
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ফেলুদা আর মতিলালবাবু দুজনেই দেখলাম রাস্তা খুব ভাল করে জানে, আর এই ঘুটিঘুটে অন্ধকারেও বেশ দ্রুতই এগিয়ে চলেছে। এক জায়গায় একটা রাস্তার আলো টিমটিম করে জ্বলছিল। সেই আলোতে দেখে নিয়েছি মতিলালবাবুর তিনজন লোকের মধ্যে একজন ভীষণ ষণ্ডা। বুঝলাম। এই হচ্ছে মনোহর।
মগনলালের রাস্তার মুখে এসে সকলে থামল। ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, আপনারা এইখানে অপেক্ষা করুন। আমাদের হয়তো মিনিট কুড়ি লাগবে।
কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই মতিলালবাবু আর ওই তিনজন লোকের সঙ্গে ফেলুদা মগনলালের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
কয়েক মিনিট দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেদের নিশ্বাস ফেলার শব্দ পাচ্ছি।