লোয়ার সাকুলার রোড, ক্যামাক স্ট্রিট পেরিয়ে স্কুটারগুলো পার্ক স্ট্রিটে পড়ে বা দিকে ঘুরল। একেবেঁকে সাপের মতো চালানোয় বোঝা যাচ্ছে এদের বেপরোয়া ফুর্তির ভাবটা। ফেলুদা রাস্তার আলো বাঁচিয়ে ভিতর দিকে চেপে বসেছে, তার মাথায় কী খেলছে। কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিরজা গালিব স্ট্রিট দিয়ে কিছুদূর গিয়ে স্কুটারগুলো আবার বাঁয়ে ঘুরল। মাকুইস স্ট্রিট। রাস্তা সরু হয়ে আসছে, পাড়া অন্ধকার, বাতিগুলো টিমটিমে। যাতে ওরা সন্দেহ না করে তাই ফেলুদার আদেশে আমাদের ড্রাইভার ট্যাক্সির স্পিড কমিয়ে ওদের সঙ্গে দূরত্বটা একটু বাড়িয়ে নিল।
আরও দুটো মোড় ঘুরে দেখলাম স্কুটারগুলো একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে।
“চালিয়ে বেরিয়ে যান, বলল ফেলুদা।
বাড়ি না। এক ধরনের হোটেল। নাম নিউ কোরিনথিয়ান লাজ। নিউ ? বাড়ির বয়স কম করে একশো বছর।
ফেলুদার কাজ শেষ। বুঝলাম। এদের ডেরাটা জানার দরকার ছিল।
বাড়ি যখন ফিরলাম তখন এগারোটা চল্লিশ। ভাড়া উঠেছে উনিশ পঁচাত্তর।
পরদিন ভোরে সিধুজ্যাঠার আবির্ভাবটা একেবারে আনএক্সপেকটেড। উনি সকালে হাঁটতে বেরোন জানি, কিন্তু সেটা লেকের দিকে। আমাদের বাড়িতে আসার মানেই কোনও একটা বিশেষ কারণ আছে।
খাতার ওজন অনেক, তাই খবরটা কপি করে এনেছি, বললেন সিধুজ্যাঠা।— সুপ্রকাশ কিনা জানি না, তবে এস. চৌধুরী বলে লিখেছে, আর বায়োকেমিস্ট সেটাও লিখেছে।
কবেকার খবর?
উনিশশো একাত্তর। মেক্সিকোতে একটা ড্রাগ কোম্পানির উপর পুলিশের হামলায় একটি বাঙালি বায়োকেমিস্ট ধরা পড়ে, নাম এস.চৌধুরী। ভেজাল ড্রাগের ব্যবসা চালাচ্ছিল; তার ফলে সব মারাত্মক ব্যাধি দেখা দিয়েছিল। লোকটার জেল হয়। এইটুকুই খবর। আসলে মাথায় ঘুরছে। সুপ্রকাশ, তাই এস. চৌধুরীর সঙ্গে নামটা ঠিক কানেক্ট করতে পারিনি। অবিশ্যি এ সেই একই এস. চৌধুরী কি না—
একই গভীর ভাবে বলল ফেলুদা।
সিধুজ্যাঠা উঠে পড়লেন। তাঁর আজ চুল কাটার দিন, নাপিত এসে বসে থাকবে। ফেলুদার পিঠ চাপড়ে, আমার কান ধরে একটা মোচড় দিয়ে, মালকোচাটা একটু ভাল করে গুজে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন।
ফেলুদা খাতা খুলে হিজিবিজি লেখা শুরু করেছে দেখে আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পর পর তিনটে প্রশ্ন লেখা রয়েছে খাতায়—
১) চাবির গর্তের ধারে আচড়ের বাড়াবাড়ি কেন?
২) কে-র অর্থ কী?
৩) অসমাপ্ত কাজটা কী?
প্রশ্নগুলো পড়ে সে সম্বন্ধে আমিও খানিকটা না ভেবে পারলাম না।
এটায় খটকা লাগার একটা কারণ থাকতে পারে। রীতিমতো জোরে ঘষা না লাগলে ইস্পাতের ওপর ওরকম দাগ পড়তে পারে না। নীহারবাবুর ঘুম কি এতই গভীর যে এত ঘষাঘষিতেও ঘুম ভাঙবে না ?
কে-র ব্যাপারট্রা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপর মনে পড়ল যে মিঃ দস্তুরের গলা শুনে দোতলার ল্যান্ডিং থেকে নীহারবাবু কে বলে উঠেছিলেন। ফেলুদা এই কে প্রশ্নে খটকার কারণ কী দেখল সেটা বুঝলাম না।
অসমাপ্ত কাজের কথাটাও নীহারবাবুই বলেছেন। অন্তত রণজিৎবাবু তাই বলেন। সেটা যে উনি গবেষণার বিষয় বলছিলেন সেটা কি ফেলুদা বিশ্বাস করে না?
ফেলুদা আরও কী সব লিখতে যাচ্ছিল, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। ওর ঘরেই এক্সটেনশন ফোন; বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে রিসিভারটা তুলে নিল।
হ্যালো।
দু-চারবার হুঁ হুঁ করে এবং শেষে আমি এক্ষুনি আসছি বলে ফোনটা রেখে ফেলুদা আলনা থেকে শার্ট ও ট্রাউজার সমেত হ্যাঁঙ্গারটা একটানে নামিয়ে নিয়ে বলল, তৈরি হয়ে নে। গোলোকধামে খুন।
আমার বুক ধড়াস।
কে খুন হল?
মিঃ দস্তুর।
বড় রাস্তা থেকে বালিগঞ্জ পার্কে ঢুকতেই দূরে সাতের একের সামনে দেখলাম পুলিশের ভ্যান আর লোকের জটিল। তাও সাহেবি পাড়া বলে রক্ষে, নইলে ভিড় আরও অনেক বেশি হত।
কলকাতার পুলিশ মহলে ফেলুদাকে চেনে না। এমন লোক নেই। গোলোকধামে ঢুকতেই ওকে দেখে ইন্সপেক্টর বকশী হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললেন, এসে পড়েছেন? গন্ধে গন্ধে হাজির?
ফেলুদা ওর একপেশে হাসিটা হেসে বলল, সুবীরবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে সম্প্রতি; ফোন করছিলেন, তাই চলে এলাম। আপনাদের কাজে কোনও ব্যাঘাত করব না। গ্যারান্টি দিচ্ছি। খুনটা হল কী ভাবে?
মাথায় বাড়ি। একটা নয়, তিনটে। ঘুমন্ত অবস্থায়! লাশ নিয়ে যাবে এইবার পোস্টমর্টেমের জন্য। ডাঃ সরকার একবার এসে দেখে গেছেন। আন্দাজ রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে।
লোকটার সম্বন্ধে কিছু জানতে পারলেন?
খুব গণ্ডগোল। সুটকেস গুছাতে শুরু করেছিল। সটকাবার তালে ছিল।
টাকাকড়ি গেছে কিছু?
মনে তো হয় না। খাটের পাশের টেবিলে ওয়ালেটে শতিনেক টাকা রয়েছে। বাড়িতে ক্যাশ বেশি রাখত বলে মনে হয় না। অথচ ব্যাঙ্কের জমার খাতা, চেক বই এসব কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। একটা সোনার ঘড়ি পাওয়া গেছে বালিশের পাশে। এখনও ভাল করে। সার্চ করা হয়নি; এবার করবে। এ পর্যস্ত যা পাওয়া গেছে তা থেকে লোকটার সঠিক পরিচয় কিছু পাওয়া যায়নি।
সুবীরবাবু মিনিট খানেক হল এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। মিঃ বকশীকে উদ্দেশ করে বললেন, সুখওয়ানি বেজায় তম্বি করছে। বলছে তার নাকি একটা জরুরি অ্যাপিয়েন্টমেন্ট আছে ডলহাউসিতে। আমি বলেছি জেরা না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া যাবে না।
ঠিকই বলেছেন, বললেন মিঃ বকশী।অবিশ্যি জেরাতে আপনিও বাদ যাবেন না।