ইটস মি মিস্টার ডাট, দৃষ্টি উপরে করে বললেন দস্তুর-আপনার ভাই এই মাত্র আপনার লস-এর কথাটা বলল। আমি আপনাকে আমার সহানুভূতি জানাচ্ছি।
চশমাটা সরে গেল। আর তার পরেই মিলিয়ে এল চটি আর লাঠির শব্দ।
আপনারা একটু বসে যাবেন না। আমার ঘরে? বললেন মিঃ দস্তুর। –সারাদিন কাজের পরে একটু সঙ্গ পেলে ভাল লাগে।
ফেলুদা আপত্তি করল না। তার কারণ অবিশ্যি আমি জানি। যে বাড়িতে ক্রাইম ঘটেছে, সে বাড়ির লোকেদের চিনে রাখা গোয়েন্দার গোড়ার কাজ।
সুখওয়ানির ঘরের পর মিঃ দস্তুরের বৈঠকখানার নেড়া ভাবটা সত্যিই দেখবার মতো। আসবাব বলতে একটা সোফা, দুটো কাউচ, একটা রাইটিং ডেস্ক আর একটা বুকশেলফ। সোফার সামনে একটা নিচু টেবিল আছে বটে, তবে সেটা নেহাতই ছোট। তারই উপর একটা মোমবাতি রাখা ছিল। ফেলুদা সেটা ওর লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দিল; এখন দেখলাম দেয়ালে একটিমাত্র ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কিছুই নেই।
ভদ্রলোক ভিতর দিয়ে গিয়েছিলেন বোধহয় চাকরকে ডাকতে; ফিরে আসতে ফেলুদা তাঁকে একটা সিগারেট অফার করল।
নো, থ্যাঙ্কস। ক্যানসারের ভয়ে ধূমপানটা বছর তিনেক হল ছেড়ে দিয়েছি। অন্যের ধূমপানে আশা করি আপত্তি নেই। আপনার অ্যাশট্রেতে অলরেডি একটা আধখাওয়া সিগারেট পড়ে আছে।
ফেলুদা টুকরোটা তুলে নিয়ে বলল, আমারই ব্র্যান্ড। চারমিনারের টুকরো আমিও দূর থেকেই চিনতে পারি।
দস্তুর বলল, অনেকবার ভেবেছি সুখওয়ানির মতো আমিও আলো-পাখার একটা ব্যবস্থা করে নিই। তারপর যখনই মনে হয়েছে যে কলকাতার শতকরা নব্বই ভাগ লোককে গরম আর অন্ধকার ভোগ করতে হচ্ছে, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেই কারণে আমিও…
আপনার তো ইলেকট্রিক্যাল গুডস-এর ব্যবসা?
ইলেকট্রিক্যাললে?
সুখওয়ানি যে বলছিলেন–
সুখওয়ানি ওই রকমই বলে। ইলেকট্রিক্যাল নয়, ইলেকট্রনিকস। বছরখানেক হল শুরু করেছি।
আপনি নিজেই?
না, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে! আমি বোম্বাই-এর লোক, তবে অনেক’দিন দেশের বাইরে। জার্মানিতে একটা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্মে কাজ করতাম। বন্ধু কলকাতা থেকে লিখলা এখানে চলে আসতে। পয়সা ওর, আমি জোগাচ্ছি অভিজ্ঞতা।
কবে এলেন কলকাতায়?
গত নভেম্বরে। বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম মাস তিনেক; এই ফ্ল্যাটের খবরটা পেয়ে এখানে চলে আসি।
চাকর কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে এল। থামস আপ। মিঃ দস্তুর ফেলুদার পরিচয় আগেই পেয়েছেন, এবার গলাটা নামিয়ে বললেন, মিঃ মিটার, আমার ঘরে মূল্যবান জিনিস নেই ঠিকই, কিন্তু একটা কথা আপনাকে না বলে পারছি না। আমার প্রতিবেশীটি কিন্তু খুব সিধে লোক নন। তার ঘরে নানারকম গোপন কারবার চলে। গৰ্হিত ব্যাপার।
আপনি জানলেন। কী করে?
আমার স্নানের ঘর আর ওর স্নানের ঘর লাগোয়া। দুটোর মাঝখানে একটা বন্ধ দরজা আছে। সে দরজায় কান লাগালে মাঝে মাঝে ওর শোবার ঘর থেকে কথাবার্তা শোনা যায়।
ফেলুদা গলা খাকরিয়ে বলল, এই ভাবে কান লাগানোও একটা গৰ্হিত ব্যাপার নয় কি?
মিঃ দস্তর একটুও অপ্ৰস্তুত না হয়ে বললেন, সেটা করতাম না! যখন দেখলাম যে আমার চিঠি ভুল করে ওর হাতে পড়লে ও জল দিয়ে খাম খুলে তারপর আবার আঠা দিয়ে সেঁটে ফেরত দেয়, তখন একটা পালটা দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি নির্বাঞ্চাট মানুষ। কিন্তু উনি যদি আমার পিছনে লাগেন তা হলে আমিও ওকে ছাড়ব না, এই বলে দিলাম।
কোল্ড ড্রিঙ্কসের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা উঠে পড়লাম।
গেটের কাছে এসে ফেলুদা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল। গত আধা ঘণ্টার মধ্যে কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে কি না। সে বলল সুখওয়ানি আর দস্তুরকে ছাড়া কাউকে দেখেনি। এটা আশ্চর্য না। সাতের এক বালিগঞ্জ পার্কের কম্পাউন্ড ওয়াল রয়েছে বাড়ির চারদিক ঘিরে। পিছন দিকের একটা বাড়ি নাকি খালি পড়ে আছে আজ। কয়েক মাস যাবৎ। জোয়ান চোর হলে পাঁচিল টপকে আসায় কোনও অসুবিধা নেই—যদিও আমাদের সকলেরই মন বলছে। এ কাজ বাড়ির লোকেই করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার বলছে—ভেতরের লোকই যে বাইরের লোককে দিয়ে কাজটা করায়নি তারই বা বিশ্বাস কী?
আমাদের গাড়ি নেই। সুবীরবাবু বলেছিলেন তাঁর গাড়িতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার কথা, কিন্তু ফেলুদা বলল হেঁটে গিয়ে ট্যাক্সি পেতে কোনও অসুবিধা হবে না।
পুলিশে একটা খবর দিলে ভাল করতেন। কিন্তু।
ফেলুদার এ প্রস্তাবটা আমার কাছে একেবারই অপ্রত্যাশিত। সুবীরবাবুও বেশ একটু অবাক হলেন। বললেন, কেন বলছেন বলুন তো!
পুলিশ সম্বন্ধে আপনার দাদার ধারণা। যাই হোক না কেন, পলাতক চার ধরার যে সব উপায় পুলিশের জানা আছে কোনও প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের তা নেই। বিশেষ করে যখন এতগুলো টাকা, তখন পুলিশকে বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নোটের নম্বর লেখা আছে বলছেন। কাজটা এমনিতেই অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
সুবীরবাবু বললেন, আপনাকে যখন আসতে বলেছি, এবং দুর্ঘটনা যখন একটা ঘটেছে, তখন আপনাকে বাদ দেবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। পুলিশ আসুক, কিন্তু তার পাশে আপনিও থাকলে শুধু আমিই নিশ্চিন্ত হব না, দাদাও হবেন! অবিশ্যি, সত্যি বলতে কী, চার কে সেটা কারুর সাহায্য ছাড়াই আমি বলতে পারি।
আপনার ছেলের কথা বলছেন কি? সুবীরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।—এ শঙ্কর ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সে জানে এ পাড়ায় ছাঁটায় বাতি নিভে যায়। ডানপিটে ছেলে, পাঁচিল টপকানা তার কাছে কিছুই নয়। তার পর পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে জ্যাঠার ঘরে ঢুকে আলমারি খোলা—এ সবই তো তার কাছে নাস্যি!