এই টেবিলের পাশে জানালার সামনে একটা আরাম কেদারা। তার পিঠে অনেক দিনের ব্যবহারের ফলে বেতের বুনুনিতে কালশিটে পড়ে গেছে। মনে হল এই আরাম কেদারাতেই বেশির ভাগ সময় কাটান নীহারবাবু।
এ ছাড়া আছে একটা কাজের টেবিল—যার উপর এখন একটা মোমবাতি টিমটিম করছে— একটা স্টিলের চেয়ার, টেবিলের উপর লেখার সরঞ্জাম, চিঠির র্যাক, একটা পুরনো টাইপরাইটার আর এক তাড়া বৈজ্ঞানিক পত্রিকা।
এই টেবিলের পাশেই, দরজার ঠিক বাঁয়ে, রয়েছে গোদরেজের আলমারিটা।
ঘরে ঢুকেই একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফেলুদা তার মিনি টর্চ দিয়ে আলমারির চাবির গর্তটা ভাল করে দেখে বলল, খোলার চেষ্টার অভাব হয়নি। গর্তের চারপাশে দাগ। তারপর এগিয়ে গিয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে বড়ির পাতাটা তুলে নিয়ে বলল, সোনেরিল।…বুঝেছিলাম নীহারবাবু বেশ কড়া ওষুধ খান। না হলে ঘুম ভেঙে যাবার কথা।
তারপর চৌকাঠের বাইরে দাঁড়ানা চাকর কৌমুদীর দিকে ফিরে বলল, তোমার ঘুম ভাঙল না? তুমি কীরকম পাহারা দাও বাবুকে?
কৌমুদীর মাথা হেঁট হয়ে গেল। সুবীরবাবু বললেন, ও বেজায় ঘুমকাতুরে। এমনিতেই তিনবার না ডাকলে ওঠে না।
বাইরে থেকে পায়ের আওয়াজ পেয়েছিলাম আগেই, এবার একটি বছর ত্ৰিশোকের ভদ্রলোক এসে ঘরে ঢুকলেন। রোগা, চোখে চশমা, চুল কোঁকড়া। সুবীরবাবু আলাপ করিয়ে দিতে বুঝলাম ইনিই নীহারবাবুর সেক্রেটারি, নাম রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কে জিতল?
ফেলুদার অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন, করা হয়েছে। সেক্রেটারি মশাইকে। রণজিৎবাবুর ফ্যালফেলে ভাব দেখে ফেলুদা হেসে বলল, আপনার পাতলা টেরিলিনের শার্টের পকেটে স্পষ্ট দেখছি খেলার টিকিটের কাউন্টারফয়েল। তার উপর রোদে মুখ ঝলসানা—লিগের বড় খেলা দেখে এলেন সেটা অনুমান করাটা কি খুব কঠিন?
ইস্টবেঙ্গল, হেসে বললেন রণজিৎবাবু। সুবীরবাবুর মুখেও তারিফ আর বিস্ময় মেশানা হাসে।
আপনি এখানে ক’দিন কাজ করছেন?
চার বছর।
নীহারবাবু তাঁর বিস্ফোরণের ঘটনার বিষয় কখনও কিছু বলেছেন?
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললেন রণজিৎবাবু, কিন্তু উনি খুলে কিছু বলতে চাননি। তবে চোখ গিয়ে যে সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে সেটা উনি মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বলে ফেলেন।
আর কিছু বলেন?
রণজিৎবাবু একটু ভেবে বললেন, একটা কথা বলতে শুনেছি যে, উনি যে এখনও বেঁচে আছেন তার কারণ হল যে ওঁর একটা কাজ এখনও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সেটা কী কাজ আমি জিজ্ঞেস করতে সাহস পাইনি। মনে হয়। উনি এখনও আশা রাখেন যে ওঁর গবেষণাটা শেষ করবেন।
নিজে তো আর পারবেন না। অন্য কাউকে দিয়ে করবেন। এটাই হয়তো ভেবেছেন। তাই নয় কি?
তাই বোধহয়।
আপনার এখানে ডিউটি কতক্ষণ?
নটায় আসি, ছটায় যাই। আজ খেলা দেখার জন্য তাড়াতাড়ি ছুটি চেয়েছিলাম, উনি আপত্তি করেননি। তবে বাইরে গেলেও সন্ধেবেলা একবার এখানে হয়ে যাই। যদি ওঁর কোনও…
গোদরেজের চাবি কোথায় থাকে? ফেলুদা হঠাৎ প্রশ্ন করল। —টাকা আর গবেষণার নোটস কী অবস্থায় থাকে সেটা একবার দেখে নিতে চাই।
ওই বালিশের নীচে।
ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে পাঁচটা চাবি সমেত একটা রিং বার করে আনল। তারপর তা থেকে প্রয়োজনীয় চাবিটা বেছে নিয়ে আলমারি খুলল।
টাকা কোথায় থাকে?
ওই দেরাজে।—রণজিৎবাবু আঙুল দেখালেন।
ফেলুদা দেরাজটা টেনে খুলল।
সে কী!
রণজিৎবাবুর চোখ কপালে। মোমবাতির আলোতেই বুঝলাম তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। দেরাজের মধ্যে একটা পাকানো কাগজ—খুলে দেখা গেল সেটা কুষ্ঠী—আর একটা কাশ্মীরি কাঠের বাক্সে কিছু পুরনো চিঠিপত্র। আর কিছু নেই।
এ কী করে হয়?—রণজিৎবাবুর গলা দিয়ে যেন আওয়াজ বেরোতে চাইছে না। —তিনটে বান্ডিল করা একশো টাকার নোট…সব মিলিয়ে প্রায় তেত্ৰিশ হাজার…
গবেষণার কাগজপত্র কি এই অন্য দেরাজটায়?
রণজিৎবাবু মাথা নাড়লেন। ফেলুদা দ্বিতীয় দেয়াজটা খুলল।
এটা একেবারেই খালি।
বাইরে পায়ের শব্দ—খট খট খট খট। নীহারবাবু ছাত থেকে নামছেন।
মিশিগ্যান ইউনিভার্সিটির একটা লম্বা সীলমোহর লাগানো খামে ছিল গবেষণার নোটস… রণজিৎবাবুর গলা খটখাটে শুকনো।
আজ সকালে ছিল টাকা আর কাগজপত্ৰ?
আমি নিজে দেখেছি, বললেন সুবীরবাবু।-–একশো টাকার নোটের নম্বরগুলো সব নোট করা আছে। দাদাই এ ব্যাপারে ইনসিস্ট করতেন।
ফেলুদা থমথমে ভাব করে বলল, তার মানে গত মিনিট পনেরোর মধ্যে—অর্থাৎ লোড শেডিং হবার পরেই—ব্যাপারটা ঘটেছে। আমরা যখন বৈঠকখানায় ছিলাম তখন।
নীহারবাবু ঢুকলেন ঘরে। তাঁর মুখ দেখে বুঝলাম তিনি বাইরে থেকে সব শুনেছেন।
আমরা পথ করে দিতে ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে তাঁর আরাম কেদারায় বসলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বোঝো!—গোয়েন্দার নাকের সামনে দিয়ে নিয়ে গেল।
সামনের সিঁড়ি ছাড়া দোতলায় ওঠার অন্য সিঁড়ি আছে? নীহারবাবুর ঘর থেকে করিডরে বেরিয়ে এসে সুবীরবাবুকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
সুবীরবাবু বললেন, জমাদারের সিঁড়ি আছে। পিছন দিকে।
লোড শেডিং কি রোজই এই সময় হয়?
তা দিন দশেক হল হচ্ছে। অনেকে তো ঘড়ি মেলাতে শুরু করেছে। ছটায় যায়, আসে দশটায়।
ভাবতে চেষ্টা করলাম ফেলুদার গোয়েন্দা জীবনে এরকম অদ্ভুত ঘটনা আর ঘটেছে কি না। একটাও মনে পড়ল না।
নীচের বাসিন্দারা কেউ ফিরেছেন কি? সিঁড়ির মুখটায় এসে ফেলুদা প্রশ্ন করল।