ইনকাম আছে কিছু? বায়োকেমিস্ট্রির উপর দাদার একটা বই বেরিয়েছিল। আমেরিকা থেকে, তার থেকে একটা রোজগার আছে।
ঘটনাটা কী?
আজ্ঞে?
মানে, আপনার এখানে আসার কারণটা…
বলছি।
পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে ধরিয়ে নিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন সুবীর দত্ত—
দাদার ঘরে কাল রাত্তিরে চোর এসেছিল।
সেটা কী করে বুঝলেন?
ফেলুদা এতক্ষণে হাত থেকে মহাভারত নামিয়ে সামনের টেবিলের উপর রেখে প্রশ্নটা করল।
দাদা নিজে বোঝেননি। ওঁর চাকরিটাও যে খুব বুদ্ধিমান তা নয়। নটার সময় ওঁর সেক্রেটারি এসে ঘরের চেহারা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। ডেস্কের দুটো দেরাজই আধাখোলা, কাগজপত্র কিছু মেঝেতে ছড়ানো, ডেস্কের উপরের জিনিসপত্র ওলট-পালট, এমনকী গোদরেজের আলমারির চাবির চারপাশে ঘষটানার দাগ; বাঝাই যায় কেউ আলমারিটা খোলার চেষ্টা করেছে।
আপনাদের পাড়ায় চুরি হয়েছে ইদানীং?
হয়েছে। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে। পাড়ায় এখন দুটো পুলিশের লোক টহল দেয়। পাড়া বলতে বালিগঞ্জ পার্ক। আমাদের বাড়িটা প্রায় আশি বছরের পুরনো। ঠাকুরদার তৈরি। খুলনায় জমিদারি ছিল আমাদের। ঠাকুরদা চলে আসেন কলকাতায় এইটিন নাইনটিতে। রাসায়নিক যন্ত্রপাতি ম্যানুফ্যাকচারিং-এর ব্যবসা শুরু করেন। কলেজ স্ট্রিটে বড় দোকান ছিল আমাদের। বাবাও চালিয়েছিলেন কিছুদিন ব্যবসা। বছর ত্রিশেক আগে উঠে যায়।
আপনার বাড়িতে এখন লোক কজন? আগের তুলনায় অনেক কম। বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। আমার স্ত্রীও, সেভেনটি ফাইভে। আমার দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বড় ছেলে জার্মানিতে। এখন মেম্বার বলতে আমি, দাদা, আর আমার ছোট ছেলে। দুটি চাকর আর একটি বান্নার লোক আছে। আমরা দোতলায় থাকি। একতলাটা দুভাগ করে ভাড়া দিয়েছি।
কারা থাকে। সেখানে?
সামনের ফ্র্যাটটাতে থাকেন। মিঃ দস্তুর। ইলেকট্রিক্যাল গুডসের ব্যবসা। পিছনে থাকেন। মিঃ সুখওয়ানি, অ্যান্টিকের দোকান আছে লিন্ডসে স্ট্রিটে।
এদের ঘরে চোর ঢোকেনি? শুনে তো বেশ অবস্থাপন্ন বলে মনে হয়।
পয়সা তো আছেই। ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়া আড়াই হাজার করে। সুখওয়ানির ঘরে দামি জিনিস আছে বলে ও দরজা বন্ধ করে শোয়। দস্তুর বলে বন্ধ ঘরে ওর সাফোকেশন হয়।
চোর আপনার দাদার ঘরে ঢুকেছিল কী নিতে অনুমান করতে পারেন?
দেখুন, দাদার অসমাপ্ত গবেষণার কাগজপত্র দাদার আলমারিতেই থাকে, আর সেগুলো যে অত্যন্ত মূল্যবান তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অবিশ্যি সাধারণ চার আর তার মূল্য কী বুঝবে। আমার ধারণা চার টাকা নিতেই ঢুকেছিল। অন্ধ লোকের ঘরে চুরির একটা সুবিধে আছে সেটা তো বুঝতেই পারেন?
বুঝেছি। বলল ফেলুদা অন্ধ মানে বোধহয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, কারণ চেক সই করা তো…
ঠিক বলেছেন। বই বাবদ দাদা যা টাকা পান সব আমার নামে আসে। আমার অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। তারপর আমি চেক কেটে টাকা তুলে দাদাকে দিয়ে দিই। সেই ব্যাঙ্কের টাকা সব ওই গোদরেজের আলমারিতেই থাকে। আমার আন্দাজ হাজার ত্ৰিশোক টাকা ওই আলমারিতে রয়েছে।
চাবি কোথায় থাকে?
যতদূর জানি, দাদার বালিশের নীচে। বুঝতেই পারছেন, দাদা অন্ধ বলেই দুশ্চিন্তা। রাত্তিরে দরজা খুলে শোন, চৌকাঠের বাইরে শোয় চাকর কৌমুদী—যাতে মাঝরাত্তিরে প্রয়োজনে ডাক দিলে আসতে পারে। ধরুন যদি তেমন বেপরোয়া চোর হয়, আর চাকরের ঘুম না ভাঙে, তা হলে তো দাদার আত্মরক্ষার কোনও উপায় থাকে না। অথচ পুলিশে উনি খবর দেবেন না। বলেন ওরা কেবল জানে জেরা করতে, কাজের বেলায় ঢু, সব ব্যাটা ঘুষখোর ইত্যাদি। তাই আপনার কথা বলতে উনি রাজি হলেন। আপনি যদি একবারটি আমাদের বাড়িতে আসেন, তা হলে অন্তত প্রিভেনশনের ব্যাপারে কী করা যায় সেটা একটু ভেবে দেখতে পারেন। এমনকী বাইরের চোর না। ভেতরের চোর সেটাও একবার—
ভেতরের চোর?
আমি আর ফেলুদা দুজনেই উৎকৰ্ণ মানে কান খাড়া।
ভদ্রলোক চুবুটের ছাই অ্যাশট্রেতে ফেলে গলাটা যতটা পারা যায় খাদে নামিয়ে এনে বললেন, দেখুন মশাই, আমি স্পষ্টবক্তা। আপনার কাছে যখন এসেছি, তখন জানি ঢেকেঢুকে কথা বললে আপনার কোনও সুবিধে হবে না। প্রথমত আমাদের দুজন ভাড়াটের একটিকেও আমার খুব পছন্দ না। সুখওয়ানি এসেছে বছর তিনেক হল। আমি নিজে জানি না, কিন্তু যারা পুরনো আর্টের জিনিস-টিনিস কেনে তেমন লোকের কাছে শুনেছি সুখওয়ানি লোকটা সিধে। নয়। পুলিশের নজর আছে। ওর ওপর।
আর অন্য ভাড়াটো?
দস্তুর এসেছে মাস চারেক হল। ও ঘরটায় আমার বড় ছেলে থাকত সে পার্মানেন্টলি দেশের বাইরে। ডুসেলডর্ফে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি করে জার্মান মেয়ে বিয়ে করেছে। দস্তুর লোকটা সম্বন্ধে বদনাম শুনিনি। তবে সে এত অতিরিক্ত রকম চাপা যে সেটাই সন্দেহের কারণহয়ে দাঁড়ায়। আর, ইয়ে-
ভদ্রলোক থামলেন। তারপর বাকি কথাটা বললেন মুখ নামিয়ে, দৃষ্টি ছাইদানিটার দিকে রেখে।
শঙ্কর, আমার ছোট ছেলে, একেবারে সংস্কারের বাইরে চলে গেছে।
ভদ্রলোক আবার চুপ। ফেলুদা বলল, কত বড় ছেলে?
তেইশ বছর বয়স। গত মাসে জন্মতিথি গেল, যদিও তার মুখ দেখিনি সেদিন।
কী করে?
নেশা, জুয়া, ছিনতাই, গুণ্ডাগিরি কোনওটাই বাদ নেই। পুলিশের খপ্পরে পড়েছে তিনবার। আমাকেই গিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। আমাদের পরিবারের একটা খ্যাতি আছে সেটা তো বুঝতেই পারছেন, তাই নাম করলে এখনও কিছুটা ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সে নাম আর কদ্দিন টিকবে জানি না।