নীহারবাবুর ঠোঁটের কোণে একটা স্নান হাসি দেখা দিল। বললেন, বিরক্ত আর করবেন কী করে? বিরক্তির অনেক উর্ধের্ব চলে গেছি যে আমি।
তা হলে বলি শুনুন। কাল টেবিলের উপর দেখেছিলাম ঘুমের ট্যাবলেট দশটা। আজও দেখছি। দশটা। আপনি কি কাল তা হলে ঘুমের ওষুধ খাননি?
না, খাইনি। আজ খাব।
তা হলে আসি আমরা!
দাঁড়ান।
নীহারবাবু তাঁর ডান হাতটা ফেলুদার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। দুজনের হাত মিলল। ভদ্রলোক ফেলুদার হাতটা বেশ ভাল করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন—
আপনি বুঝবেন। আপনার দৃষ্টি আছে।
বাড়িতে এসেও ফেলুদা গম্ভীর। কিন্তু তা বলে আমি অত রহস্য বরদাস্ত করব কেন? চেপে ধরে বললাম, ঢাকা ঢাক গুড গুড চলবে না। সব খুলে বলো।
ফেলুদা উত্তরে রামায়ণে চলে গেল। ওর সাসপেন্স বাড়ানোর কিছু কায়দা আমি সত্যিই বুঝে উঠতে পারি না।
রামকে বনবাসে পাঠানের ছদিন পর দশরথের হঠাৎ মনে পড়েছিল যে তিনি যুবরাজ অবস্থায় একটা সাংঘাতিক কুকীর্তি করে ফেলেছিলেন, আর সেই কারণেই আজ তাঁকে পুত্ৰশোক ভোগ করতে হচ্ছে। তোর মনে আছে সে কুকীর্তিটা কী?
রামায়ণটা টাটকা পড়া ছিল না, কিন্তু এ ঘটনাটা মনে ছিল। বললাম, অন্ধমুনির ছেলে রাত্রে নদীতে জল তুলিছিল কলসিতে। দশরথ অন্ধকারে শব্দ শুনে ভাবলেন বুঝি হাতি জল খাচ্ছে। উনি শব্দভেদী বাণ মেরে ছেলেটিকে মেরে ফেলেছিলেন।
গুড। অন্ধকারে শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করার এই ক্ষমতাটা ছিল দশরথের। নীহারবাবুরও ছিল।
নীহারবাবু।—আমি প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম।
ইয়েস স্যার, বলল ফেলুদা।-রাত জগতে হবে বলে ঘুমের ওষুধ খাননি। সবাই যখন ঘুমে অচেতন, তখন খালি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যান দস্তুর সুপ্রকাশের ঘরে। এই ঘরে এক কালে ওঁর ভাইপো থাকত। ঘর ওঁর চেনা। হাতে ছিল অস্ত্ৰ-রুপো দিয়ে বাঁধানো জাঁদরেল লাঠি! খাটের কাছে গিয়ে লাঠি দিয়ে মোক্ষম ঘা। একবার নয়, তিনবার।
কিন্তু…কিন্তু…
আমার এখনও সাংঘাতিক গোলমাল লাগছে। এ সব কী বলছে ফেলুদা? লোকটা তো অন্ধ!
একটা কথা কি মনে পড়ছে না তোর? অসহিষ্ণুভাবে বলল ফেলুদা।সুখওয়ানি কী বলেছে দস্তুর সম্পর্কে?
বিদ্যুতের ঝলকের মতো কথাটা মনে পড়ে গেল।–
দস্তুরের নাক ডাকত!
এগজ্যাক্টলি! বলল ফেলুদা।-তার মানে বালিশের কোনখানে মাথা.কোন পাশে ফিরে রয়েছে, এ সবই বুঝতে পেরেছিলেন নীহারবাবু। যার শ্রবণশক্তি এত প্রখর, তার আর এর চেয়ে বেশি জানার কী দরকার? এক ঘায়ে যদি না হয়, তিন ঘায়ে তো হবেই!
আমি কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে বললাম, এই অসমাপ্ত কাজটার কথাই কি বলেছিলেন নীহারবাবু? প্রতিশোধ?
প্রতিশোধ, বলল ফেলুদা, জিঘাংসা। অন্ধেরও দেহমানে প্রচণ্ড শক্তির সঞ্চার করতে পারে এই প্রবৃত্তি। এই জিঘাংসাই তাঁকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। এখন তিনি মৃত্যুশয্যায়। আর সেই কারণেই তিনি আইনের নাগালের বাইরে।
আরও সতেরো দিন বেঁচে ছিলেন নীহাররঞ্জন দত্ত। মারা যাবার ঠিক আগে তিনি উইল করে তাঁর গবেষণার কাগজপত্র আর জমানে টাকা দিয়ে গেছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত মেধাবী সেক্রেটারি রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।