ফেলুদা তার ঘরেই ফোন ধরল; আমি বসবার ঘরের ফোনে কান লাগিয়ে দু। তরফের কথাই শুনে নিলাম।
হ্যালো।
কে, মিঃ মিত্তির?
বলুন মিঃ দত্ত।
দাদার গবেষণার নোটস সমেত সীল করা খামটা পাওয়া গেছে।
দস্তুরের ঘরে ছিল কি?
ঠিক বলেছেন। খাটের পাটাতনের তলায় সেলেটেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল। একদিকের সেলেটেপ খুলে গিয়ে ঝুলছিল। পেয়েছে আমাদের চাকর ভগীরথী।
আপনার দাদা জানেন খবরটা?
তা জানেন। তবে দাদার মধ্যে কেমন যেন একটা হাল-ছেড়ে—দেওয়া ভাব এসেছে। কোনও ব্যাপারেই যেন বিশেষ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। আজ সারাদিন চেয়ার ছেড়ে ওঠেননি। আমি আমাদের ডাক্তারকে আসতে বলেছি।
আপনার ছেলের কোনও খবর আছে?
আছে। জি টি রোডে ওদের পুরো দলটাই ধরা পড়েছে।
আর চোরাই টাকা?
সেটা নিলেও অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছে। অবিশ্যি চুরির ব্যাপারটা শঙ্কর সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে।
খুনের ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে?
ওরা সুখওয়ানিকেই সন্দেহ করছে। তা ছাড়া একটা নতুন ক্লু-ও পাওয়া গেছে। দস্তুরের জানলার বাইরে পড়ে থাকা একটা দলা পাকানো কাগজ।
কী লেখা আছে তাতে?
ইংরেজিতে এক লাইন হুমকি—অতিরিক্ত কৌতুহলের পরিণাম কী জান তো?
সুখওয়ানি কী বলে?
সে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। তার ঘর থেকে যে দস্তুরের ঘরে যাবার কোনও উপায় নেই সেটা ঠিকই, কিন্তু একটা ভাড়াটে গুণ্ডা পাইপ বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে তারপর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে অনায়াসেই সে কাজটা করতে পারে।
হুঁ…ঠিক আছে, আমি একবার আসছি।
ফেলুদা ফোনটা রেখে দিয়ে প্রথমে আপন মনে বিড়বিড় করে বলল, x আর Y তা হলে একই লোক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে z-কে নিয়ে। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ডেসটিনেশন গোলোকধাম। তৈরি হয়ে নে তোপ্সে।
০৪. শব্দভেদী বাণ
আপনি চললেন নাকি?
গোলোকধামের গেট দিয়ে ঢুকে দেখি রণজিৎবাবু আসছেন। বাইরে পুলিশ দেখে বুঝেছি বাড়িটার উপর নজর রাখা হয়েছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন রণজিৎবাবু, নীহারবাবু বললেন আজ আর আমাকে প্রয়োজন হবে না।
উনি আছেন কেমন?
ডাক্তার এসেছিলেন। বললেন বাড়িতে এতগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটাতে শক পেয়েছেন। প্রেসারটা ওঠানামা করছে।
কথা বলছেন কি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তা বলছেন, আশ্বাসের সুরে বললেন রণজিৎবাবু।
যে খামটা পাওয়া গেছে দস্তুরের ঘর থেকে সেটা একবার দেখব। আপনার খুব তাড়া না। থাকলে আর একবারটি চলুন ওপরে। আলমারিতে আছে তো। ওটা?
হ্যাঁ।
আপনাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখব না কথা দিচ্ছি। এ বাড়িতে তো আর বিশেষ অ্যাস-টাসা হবে।
কিন্তু খাম তো সীল করা, কিন্তু-কিন্তু ভাব করে বললেন রণজিৎবাবু।
তা হলেও আমি জিনিসটা একবার শুধু হাতে নিয়ে দেখতে চাই।
রণজিৎবাবু আর আপত্তি করলেন না।
আজও বাড়ি অন্ধকার, দশটার আগে আলো আসবে না, এখন বেজেছে মাত্র সোয়া-ছটা। দোতলার বারান্দায় আর ল্যান্ডিং-এ কেরোসিন ল্যাম্প জ্বললেও আনাচে-কানাচে অন্ধকার।
রণজিৎবাবু আমাদের বৈঠকখানায় বসিয়ে সুবীরবাবুকে খবর দিতে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন যে নীহারবাবু যদি খামটা আলমারি থেকে বার করার ব্যাপারে আপত্তি করেন, তা হলে কিন্তু সেটা দেখানো সম্ভব হবে না।
সেটা বলাই বাহুল্য, বলল ফেলুদা।
সুবীরবাবুকে দেখে বেশ ক্লান্ত বলে মনে হল। বললেন। সারাদিন নাকি খবরের কাগজের রিপোর্টারদের ঠেকিয়ে রাখতেই কেটে গেছে। তবে একটা ভাল। এই যে, দাদার নামটা লোক ভুলতে বসেছিল, এই সুবাদে আবার মনে পড়ছে।
মিনিটখানেকের মধ্যেই রণজিৎবাবু এলেন, হাতে লম্বা সাদা খাম। বললেন, নীহারবাবু আপনার নাম শুনেই বোধহয় আপত্তি করলেন না। এমনিতে কাউকে দেখতে দিতেন না।
আশ্চৰ্য, ফেলুদা খামটা হাতে নিয়ে ল্যাম্পের তলায় এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে মন্তব্য করল। আমার চোখে মনে হচ্ছে সাধারণ লম্বা খাম, পিছনে লাল গালার সীল, সামনের দিকে ওপরের বা কোণে ছাপার হরফে লেখা ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োকেমিস্ট্রি, ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, মিশিগ্যান, ইউ এস এ। এতে যে আশ্চর্যের কী আছে জানি না। সুবীরবাবু আর রণজিৎবাবু বসে আছেন আবছা অন্ধকারে, তাঁদেরও মনের অবস্থা নিশ্চয়ই আমার মতো।
ফেলুদা সোফায় এসে বসল, তার দৃষ্টি তখনও খামটার দিকে। তারপর দুই ভদ্রলোককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, শুধু আমাকেই উদ্দেশ করে কথা বলতে শুরু করল। ভাবটা স্কুলমাস্টারের। এই মেজাজে অনেক সময় অনেক বিষয়ে অনেক জ্ঞান দিয়েছে ফেলুদা আমাকে!
বুঝেছিস তোপ্সে, আশ্চর্য জিনিস এই ইংরেজি হরফ। বাংলায় সব মিলিয়ে গোটা দশ বারো ধাঁচের হরফ আছে, আর ইংরিজিতে আছে কম পক্ষে হাজার দুয়েক। একটা তদন্তের ব্যাপারে আমাকে এই নিয়ে কিছুটা পড়াশুনা করতে হয়েছিল। হরফের শ্রেণী আছে, জাত আছে, প্রতিটি শ্রেণীর আলাদা নাম আছে। যেমন এই বিশেষ ডিজাইনের হরফের নাম হল গ্যারামণ্ড।-ফেলুদা খামের উপর ছাপা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের দিকে আঙুল দেখাল। তারপর বলে চলল—
এই গ্যারামন্ড টাইপের উদ্ভব ষোড়শ শতাব্দীতে, ফ্রান্সে। তারপর ক্রমে এই টাইপ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইটজারল্যান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে শুধু যে এই টাইপের প্রচলন হয় তা নয়, ক্রমে এই সব দেশের নিজস্ব কারখানায় এই টাইপের ছাঁচ তৈরি করা শুরু করা হয়। এমনকী সম্প্রতি ভারতবর্ষেও এটা হচ্ছে। মজা এই যে, খুব ভাল করে দেখলে দেখা যায় যে এক দেশের গ্যারামন্ডের সঙ্গে অন্য দেশের গ্যারামন্ডের সূক্ষ্ম তফাত রয়েছে। কয়েকটা বিশেষ বিশেষ অক্ষরের গড়নে এই তফাতটা ধরা পড়ে। যেমন এই খামের উপরের হরফট হওয়া উচিত আমেরিকান গ্যারামণ্ড, কিন্তু তা না হয়ে এটা হয়ে গেছে ইণ্ডিয়ান গ্যারামন্ড। এমনকী ক্যালকাটা গ্যারামণ্ডও বলতে পারিস।