আমি একটু ভেবে বললাম, মোটামুটি।
সুখওয়ানির ঘর থেকে দস্তুরের ঘরে কীভাবে যাওয়া যায় বল তো?
আমি আবার একটু ভাবলাম। তারপর বললাম, যদ্দূর মনে পড়ছে, দুটো ফ্ল্যাটের পাশ দিয়ে বাড়ির ভিতরে যে বরাদ্দাটা গেছে, তার মাঝখানে একটা দরজা রয়েছে, আর সে দরজাটা বোধ হয় বন্ধ থাকে। সেটা খোলা থাকলে সেই বারান্দা দিয়েই সোজা এক ফ্ল্যাট থেকে আরেক ফ্ল্যাটে চলে যাওয়া যেত।
ঠিক বলেছিস। তার মানে সুখওয়ানিকে যদি দস্তুরের ফ্ল্যাটে আসতে হয় তা হলে বাগান ঘুরে বাড়ি আর কম্পাউন্ড-ওয়ালের মধ্যের গলি দিয়ে একেবারে সামনে এসে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়।
কিন্তু সামনের কেল্যাপসিবল গেট কি মাঝরাত্তিরে খোলা থাকবে?
নিশ্চয়ই না?
তারপর আবার পায়চারি শুরু করে বলতে লাগল—
X, Y, Z…X, Y, Z…X হল গবেষণার কাগজ, Y হল টাকা, আর Z হল খুন। এখন কথা হচ্ছে— X, Y, Z, কি একই সূত্রে গাঁথা, না তিনটে আলাদা…
আমি এক ফাঁকে বলে ফেললাম, ফেলুদা, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে যে সুপ্রকাশ চৌধুরী দস্তুর সেজে নীহারবাবুর বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে এসেছিলেন।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম দেখে যে ফেলুদা মোটেই আমার কথাটা উড়িয়ে দিল না। বরং আমার পিঠে দুটো চাপড় মেরে বলল, যদিও এ ধারণাটা আমার মাথায় আগেই এসেছে, তবুও বলতেই হয়। আজকাল তোর চিন্তায় মাঝে মাঝে বেশ ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু দস্তুর যদি সুপ্ৰকাশ হয়, তা হলে মনে করা যেতে পারে সে গবেষণার নেটসের লোভেই ওখানে আস্তানা নিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই যদি খামটা চুরি করে থাকে তা হলে সেটা গেল কোথায়? আর তার পক্ষে নিজে চুরি করাটা সম্ভবই বা হয় কী করে? সে তো দোতলায় কোনওদিন যায়ইনি।
আমার সত্যিই মাথা খুলে গেছে। ব্যাপারটা তো জলের মতো সোজা! বললাম, উনি যাবেন। কেন? ধরা যদি ওঁর সঙ্গে শঙ্কর দত্তর ষড় হয়ে থাকে? শঙ্করই কাগজটা চুরি করে ওকে এনে দিয়েছে, আর তার জন্য কিছু টাকাও পেয়ে গেছে।
এক্সেলেন্ট বলল ফেলুদা।অ্যাদিনে বলা যায় তুই আমার উপযুক্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট হলি। কিন্তু এতে তো খুনের রহস্যের সমাধান হচ্ছে না।
ধরে যদি রণজিৎবাবু বুঝে থাকেন যে দস্তুর আসলে সুপ্ৰকাশ। রণজিৎবাবু তো নীহারবাবুর সব ব্যাপারই জানেন, আর সেই সঙ্গে নীহারবাবুকে দারুণ ভক্তিও করেন। যে লোক নীহারবাবুর ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়েছিল, তার উপর প্রচণ্ড আক্ৰোশে খুন করতে পারেন না রণজিৎবাবু?
ফেলুদা মাথা নাড়ল।
খুন জিনিসটা অত সহজ নয় রে তোপ্সে। রণজিতের মোটিভটাকে মোটেই জোরালো বলা চলে না। আসল আপশোঁসের ব্যাপার হচ্ছে যে দস্তুর লোকটার ঘরে সার্চ করে এখন অবধি কিছু পাওয়া গেল না। অত্যন্ত সাবধানী লোক ছিলেন এই দস্তুর।
আমার কী মনে হয় জান ফেলুদা?
ফেলুদা পায়চারি থামিয়ে আমার দিএক চাইল। আমি বললাম, ‘পুলিশের বদলে তুমি যদি সার্চ করতে তা হলে অনেক রকম ক্লু পেতে।
বলছিস?
ফেলুদা নিজের ওপর কনফিডেন্স হারাচ্ছে এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না; কিন্তু ওর ওই বলছিস কথাটাতে যেন ওটারই একটা আভাস পেলাম। আর তারপর যে কথাটা বলল তাতে মনটা আরও দমে গেল।
এই গরম আর এই লোড শেডিং-এ আইনস্টাইনেরও মাথা খুলত কিনা সন্দেহ।
দুটো নাগাদ ইন্সপেক্টর বকশীর ফোন এল। দস্তুরের একটা জুতোর গোড়ালির মধ্যে একটা চোরা খুপরিতে অ্যামেরিকান ডলার আর জার্মান মার্ক মিলে প্ৰায় সতেরো হাজার টাকা পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন কোনও কাগজ বা দলিল পাওয়া যায়নি যা থেকে লোকটার বিষয় কিছু জানা যায়। ইলেকট্রনিকস-এর নতুন কোনও দোকানের হদিস মেলেনি, দস্তুরের কোনও বন্ধুরাও সন্ধান পাওয়া যায়নি। চিঠিপত্র প্রায় ছিল না বললেই চলে। একটি মাত্র ব্যক্তিগত চিঠি, আর্জেন্টিনা থেকে লেখা, যা থেকে বোঝা যায় যে সে দক্ষিণ আমেরিকায় কিছুদিন কাটিয়েছিল।
বকশীর দ্বিতীয় খবর হচ্ছে এই যে, নিউ কোরিনথিয়ান লজের ম্যানেজারকে ছবি দেখাতে সে শঙ্করকে চিনেছে; কাল সারারাত নাকি শঙ্কর কয়েকজন বন্ধু সমেত হোটেলের একটা ঘর ভাড়া করে সেখানে নেশা করেছে আর জুয়া খেলেছে। সকাল হতে তারা পাওনা চুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। বকশী বললেন এবার শঙ্করকে ধরা নাকি এ ম্যাটার অফ মিনিটস।
ফেলুদা সব শুনেটুনে ফোনটা রেখে দিয়ে বলল, শঙ্করবাবু যদি হোটেলের পেমেন্টটা চুরির টাকায় করতেন তা হলে খুব সুবিধে হত। যাই হাক, এটা প্রমাণ হয়ে গেল যে খুনটা সে করেনি, কারণ সেই সময়টা তার অ্যালিবাই ছিল।
অ্যালিবাই কথাটার মানে অবিশ্যি আমি অনেকদিন থেকেই জানি, কিন্তু যারা জানে না তাদের বাংলায় কীভাবে বোঝানো যায় জিজ্ঞেস করাতে ফেলুদা বলল, ডিকশনারিতে যা লেখা আছে তাই লিখে দে। তাই বলছি, অ্যালিবাই মানে হল—অপরাধের অনুষ্ঠানকালে অন্যত্র থাকার অজুহাতে রেহাই পাইবার দাবি। তার মানে আমার বাড়িতে যখন খুন হয় তখন আমি কোরিনথিয়ান লজে বসে জুয়া খেলছিলাম—এটাই হবে শঙ্করের অ্যালিবাই।
টেলিফোনটা পেয়েও ফেলুদার উসখুস ভাব গেল না। তিনটে নাগাদ দেখি ও পায়জামা ছেড়ে ট্রাউজারস পরেছে। বলল কতগুলো তথ্য সংগ্ৰহ করতে হবে তাই বেরোচ্ছে। ফিরল প্ৰায় সাড়ে চারটেয়। আমি এই দেড় ঘণ্টা একটানা মহাভারত পড়ে শেষ করে ফেলেছি।
মহাপ্ৰস্থানের পথে দ্রৌপদী নকুল সহদেব সবাই একে একে মরে গিয়ে ঠিক যখন অৰ্জ্জুনের পতন হব-হব, তখন ক্রিং করে ফোনটা বেজে উঠল। আমিই ধরলাম। ফেলুদার ফোন, গোলোকধাম থেকে সুবীরবাবু কথা বলতে চাইছেন।