কালিকিঙ্কর ঘোষের বাড়ি কোত্তন শুনছিলুম! ইচ্ছে করলে যাচাই করে নিতে পারেন।
ঠিক আছে; আপনাকে আর কোনও প্রশ্ন করার নেই।
এবার এলেন দীপেন বোস। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, ঠোঁটের কোণে একটা সিগারেট, দাড়ি-গোঁফ নেই।
ভদ্রলোক প্রথমেই বললেন, আমি আর নেপাল প্রায় এক সঙ্গেই অপ্সরা থিয়েটারে জয়েন করি। সে ছিল জাত অভিনেতা। আমারও অ্যাম্বিশন ছিল, কিন্তু দেখলাম নেপালের সঙ্গে পেরে উঠব না।
তাতে আপনার মনে ঈর্ষা জাগেনি?
তা জেগেছে বইকী। বিলক্ষণ জেগেছে। অনেকদিন মনে মনে ভেবেছি-এই লোকটা আমার পথে কাঁটা হয়ে রয়েছে—এটাকে সরানো যায় না?
এই চিন্তাকে কার্যে পরিণত করার ইচ্ছা হয়নি কোনওদিন?
পাগল! আমরা ছাপোষা লোক। আমাদের দিয়ে কি খুনখারাপি হয়? নাটক করি, তাই নানারকম নাটকীয় চিন্তা মাথায় আসে—ব্যাস, ওই পর্যন্ত।
যেদিন খুনটা হয় সেদিন সন্ধ্যাবেলা আপনি কী করছিলেন?
বায়স্কোপ দেখছিলাম। তবে প্রমাণ দিতে পারব না। টিকিটের অর্ধাংশ আমি কখনও রাখি না।
কী ছবি দেখলেন?
মনের মানুষ।
কেমন লাগল?
থার্ড ক্লাস।
ঠিক আছে, আপনি আসতে পারেন।
তৃতীয় অভিনেতার নাম ভুজঙ্গ রায়। এঁর বয়স পঞ্চাশের উপর, চোখা নাক, চোখ কোটরে বসা, গাল তোবড়ানো, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে।
আপনার সঙ্গে নেপালবাবুর সদ্ভাব ছিল?
এই থিয়েটারে নেপালই ছিল আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার কিছু বলার আছে?
এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি থিয়েটার-মহলে অনেকদিন হয়নি। নেপাল ছিল আশ্চর্য অভিনেতা। আমার সঙ্গে কোনওদিন ক্ল্যাশ হয়নি, কারণ ও করত নায়কের রোল আর আমি করতুম ক্যারেকটার পার্ট।
উনি হুমকি চিঠি পাচ্ছিলেন সেটা আপনাকে বলেছিলেন?
প্রথম দিনই। আমি ওকে ওয়ার্নিং দিই—এসব চিঠি উড়িয়ে দিয়ে না, আর বিশেষ করে মতি মিস্ত্রি লেনে কিছুদিন যাওয়া বন্ধ করে। ও পাড়াটা নটারিয়াস। কে কার কথা শোনে? নেপালের বিশ্বাস ছিল তার আয়ু বিরাশি বছর—সেটা কেউ খণ্ডাতে পারবে না।
তা হলে আপনার ধারণা গুণ্ডার হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়?
তাই তো মনে হয়, কারণ তার দামি ঘড়িটাও তো পাওয়া যায়নি। সোনার ওমেগা ঘড়ি, দাম ছিল সাত হাজার টাকা।
ভুজঙ্গবাবুকে ছেড়ে দিলাম। উনি আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।
এবার এলেন নতুন অভিনেতা, নাম সুধেন্দু চক্রবর্তী। প্রথম দেখে একটু হকচাকিয়ে যেতে হয়, কারণ মোগলাই দাড়ি আর গোঁফ দেখে মনে হয়। উনি মেক-আপ নিয়ে রয়েছেন। বললেন, অপ্সরা থিয়েটারে আলমগীর হচ্ছে শুনেই তিনি দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেন। আগে শুধু গোঁফ। छिन।
আপনি এর আগে কোথায় অভিনয় করতেন? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
কোথাও না। দু-একটা আপিস ক্লাবে করেছি। আমার প্লাইউডের ব্যবসা ছিল। তবে অভিনয় আমার নেশা। আর কিছু না করার থাকলে আমি নাটকের বই খুলে পার্ট মুখস্থ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতাম। এখন অবশ্য তার আর দরকার হবে না।
আপনি কি আলমগীরে পার্ট পেয়ে গেছেন?
সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে কোন পার্ট সেটা এখনও স্থির হয়নি। মেন পার্টও হতে পারে।
আপনি থাকেন কোথায়?
অ্যামহাস্ট রো।
ব্যবসা কি এখন ছেড়ে দেবেন?
হ্যাঁ। অ্যাকটিংই আমার ধ্যান ছিল; সুযোগ পাইনি বলে ব্যবসা চালাচ্ছিলাম।
ফেলুদাকে যাতে ঠিকভাবে রিপোর্ট দিতে পারি। তাই আমি কথোপকথনটা টেপ রেকর্ভারে রেকর্ড করে নিচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম লালমোহনবাবু প্রশ্নগুলো করছিলেন নিজেকে ফেলুদা হিসেবে কল্পনা করেই। এটা আমাদের কাছে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।
সুধেন্দুবাবুকে আর একটাই প্রশ্ন করার ছিল।
আপনার সঙ্গে নেপালবাবুর আলাপ হয়েছিল?
সামান্যই। তবে ওঁর অভিনয় আমি আগে অনেক দেখেছি। খুব ভাল লাগত।
০৭. আমাদের রিপোর্ট
ফেলুদা খুব মন দিয়ে আমাদের রিপোর্ট শুনল। তারপর বলল, আমার অ্যাবসেন্সে তো তোরা বেশ চালিয়ে নিতে পারছিস।।
লালমোহনবাবু বললেন, প্রশ্ন করাটাতে খুব একটা বুদ্ধি লাগে না, আসল কথা হচ্ছে উত্তরগুলো থেকে কী বোঝা গেল। আমি তো মশাই এখনও যেই তিমিরে সেই তিমিরে। আর গুণ্ডা। যদি মেরে থাকে লাহিড়ীকে তাহলে তো পুলিশ তার কিনারা করবেই।
গুণ্ডারা হুমকি চিঠি দিয়ে খুন করে না।
তা বটে। তা আপনার কি মনে হয় নেপাল লাহিড়ী আর মহীতোষ রায়কে একজন লোকই খুন করেছে?
একজন বা একই দল। সেটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু মোটিভটা–?
ধরুন যদি অন্য থিয়েটারের লোক খুনটা করে থাকে, সেখানে তো স্পষ্ট মোটিভ রয়েছে। অপ্সরা থিয়েটারে এখন টুপ দুজন অভিনেতাই চলে গেল। ওদের আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে কি কম সময় লাগবে?
ফেলুদার পায়ে এখনও বেশ ব্যথা। বোধ হয় এক্স-রে করাতে হবে। ব্যান্ডেজ-বাঁধা পা কফি টেবিলের উপর তুলে ও সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিল। বলল, তোরা তো অনেক কাজ করলি, এবার আমায় একটু নিরিবিলি কাজ করতে দে।
কী কাজ করবে তুমি?
চিন্তা করব। একটা আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছি। অন্ধকারের মধ্যে। সেইটে আরও উজ্জ্বল হওয়া দরকার।
লালমোহনবাবু বললেন, আপনি ভাবুন, আমি আপনাকে কোনওরকম ডিসটার্ব না করে এক কাপ চা খাব। তপেশ ভাই, ভেতরে একটু বলে দিয়ে এসো না!
ফেলুদা দেখলাম ভ্রূকুটি করে চোখ বুজে ফেলেছে। শেষটায় কি ও ঘরে বসেই রহস্যের সমাধান করে ফেলবে নাকি?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও একটা প্রশ্ন করল।