বলেছিল বইকী, কিন্তু সে পাত্তাই দেয়নি। এক নাম করা জ্যোতিষী তাকে বলেছিল। সে বিরাশি বছর বাঁচবে। সেটা সে বিশ্বাস করত। বলত ওই বয়স অবধি সে অভিনয় চালিয়ে যাবে, আর মঞ্চের উপর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে।
শশধর বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এর বেশি আমার আর কিছু বলার নেই, জানেন। আর আমার মন মেজাজও ভাল নেই। আপনারা বরং আসুন।
আমরা উঠে পড়লাম।
এক সকালের পক্ষে অনেক কাজ হয়েছে মনে করে আমরা বাড়ির দিকেই রওনা দিলাম। ফেলুদাকে সব রিপোর্ট করতে হবে।
ফেলুদা সব শুনোটুনে লালমোহনবাবুর খুব তারিফ করল। বলল, আপনি তো একেবারে পেশাদারি গোয়েন্দার মতো কাজ করেছেন। যেটা বাকি রইল সেটা হচ্ছে অপ্সরা থিয়েটারের অন্য প্রধান অভিনেতাদের জেরা করা। বিশেষ করে টপ অভিনেতা-যাদের সঙ্গে নেপাল লাহিড়ীর হৃদ্যতাও ছিল, রেষারেষিও ছিল।
তোমার পা কী বলে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এখনও নষ্ট নড়ন-চড়ন। আরও দুদিন অন্তত লাগবে সারিতে। ভাল কথা অভিনেতাদের সঙ্গে যখন কথা বলবেন তখন নতুনটিকেও বাদ দেবেন না।
না না, তা তো নয়ই।
।লালমোহনবাবু ফেলুদার কাজটা করে খুব খোশমেজাজে ছিলেন। বললেন, এ এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। আসলে আপনার কাজটা যত কঠিন বলে মনে হয় তত কঠিন নয়।
কঠিন কেবল রহস্যোদঘাটন।
তা বটে, তা বটে। সেটা এখনও পারব না নিশ্চয়ই। আর সেরকম দাবিও করছি না। তবে একটা কথা বলতে পারি।–আজ ওখানে আমাকে দেখলে আপনি চিনতেই পারতেন না।
বটে?
সেন্ট পারসেন্ট।
ওখানে কি মহড়া চলছে?
আমি বললাম, চলছে বোধহয়। কয়েক’দিনের মধ্যেই তো আলমগীর শুরু হবে।
তা হলে ম্যানেজারকে টেলিফোন করে কোন সময় গেলে সকলের সঙ্গে দেখা হবে। আর কথা বলা যাবে সেটা জেনে নিবি।
ভেরি গুড।
পুলিশ দেখলি?
কইনা তো।
আছে নিশ্চয়ই। কাগজে তো লিখেছে তারা তদন্ত চালাচ্ছে। একবার ইনস্পেক্টর ভৌমিককে ফোন করব। তার আন্ডারেই কেসটা পড়বে বলে মনে হচ্ছে।
০৬. ইনস্পেক্টর ভৌমিকের সঙ্গে কথা
ইনস্পেক্টর ভৌমিকের সঙ্গে কথা বলে ফেলুদা জানল যে পুলিশ একটা গুণ্ডার দলকে সন্দেহ করছে। নেপালবাবুর নাকি একটা সোনার ঘড়ি ছিল সেটা খুনের পর পাওয়া যায়নি। খুবই দামি ঘড়ি, এবং সেটাই হয়তো খুনের কারণ হতে পারে। ফেলুদা বলল, তা হলে থিয়েটারের সঙ্গে এ-খুনের কোনও সম্পর্ক নেই বলছেন। তাতে ভৌমিক বললেন ওঁর। তাই ধারণা। একটা গুণ্ডার দল কিছুদিন থেকেই নাকি ওই অঞ্চলে উৎপাত করছে। তারা প্ৰায় সকলেই দাগি আসামি। ছুরিটা নেপালবাবুর গায়েই বিঁধে ছিল, কিন্তু তাতে কোনও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। সব শেষে ভৌমিক বললেন, তিনি আশা করছেন দিন তিনেকের মধ্যেই কেসটার নিম্পত্তি হয়ে যাবে; এবার আর আপনাকে কোনও ভূমিকা নিতে হবে না, বললেন ভদ্রলোক।
ফেলুদা টেলিফোনটা রেখে বলল, ম্যানেজারকে ওই ফোনটা করে নে। অভিনেতাদের একবার জেরা করা দরকার।
আমি তখনই অন্সর থিয়েটারে ফোন করলাম। বার তিনেক ডায়াল করবার পর লাইন পেলাম! ম্যানেজার বললেন, পুলিশ এক দফা জেরা করে গেছে সকলকে। তবে আপনারা যদি আবার করতে চান তা হলে বিযুদবার সকাল সাড়ে দশটায় আসুন। সেদিন এগারোটায় রিহার্সাল আছে; আপনাদের আধা ঘণ্টায় কাজ শেষ করতে হবে।
আমি ফোনটা নামিয়ে রাখার পর ফেলুদা বলল, টপ তিনজন আর ওই নতুন অ্যাকটরটিকে জেরা করলেই হবে।
বিষ্যুদবার সাড়ে দশটার পাঁচ মিনিট আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম অন্সর থিয়েটারে। ফেলুদাকে দেখে এসেছি তার আজও পায়ে ব্যথা রয়েছে। লালমোহনবাবু আজ আরও স্মার্ট, তার হাঁটা চলা এবং কথা বলার ঢংই বদলে গেছে।
আমরা প্রথমে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বললাম যে আমরা তিনজন টপ অভিনেতা আর নতুন অভিনেতাটিকে প্রশ্ন করতে চাই।
তা হলে ধরণীকে দিয়ে শুরু করুন। ধরণী সান্যাল। সে এখানের সিনিয়ারমোস্ট আর্টিস্ট; ছাব্বিশ বছর হল কাজ করছে।
আমাদের জেরার জন্য ম্যানেজারের পাশের ঘরটা খালি করে দেওয়া হল। ঘরে একটা সোফা আর তিনটে চেয়ার রয়েছে।
একজন বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। সিংহের কেশরের মতো চুল-তার বেশির ভাগই সাদা-ঢুলু ঢুলু চোখ, গায়ের রং মাঝারি।
আমার নাম ধরণী, সান্যাল, বললেন ভদ্রলোক, আপনারা গোয়েন্দা?
আজ্ঞে হ্যাঁ, সোজাসুজি বললেন লালমোহনবাবু। আমরা নেপাল লাহিড়ীর ব্যাপারে তদন্ত করছি।
নেপাল হুমকি চিঠি পাচ্ছিল, বললেন ধারণীবাবু। তাকে বললুম সাবধান হতে, সে কথা কানেই তুললে না। এর মধ্যে গেছে মতি মিন্ত্রি লেনে। আরে বাবা, বন্ধুর সঙ্গে ক’দিন না হয় নাই দেখা করলে। আমি তো ওকে পুলিশে খবর দিতে বলেছিলাম, কিন্তু ও গা-ই করেনি। ঠিক এরকম হয়েছিল আমাদের আরেক অভিনেতার—মহীতোষ রায়। অবিশ্যি মহীতোষের মৃত্যুটা থিয়েটারের পক্ষে তত বড় লস নয়।
নেপালবাবুর কোনও শত্রু ছিল বলে জানেন?
থিয়েটারের টপ পোজিশনে বসে থাকলে তার শত্রু থাকবেই। মানুষের ছয় রিপুর মধ্যে একটি হল মাৎসৰ্য। নেপালের শত্রু থাকবে না? তবে যদি জিজ্ঞেস করেন কোন শত্রু এই কুকীর্তি করেছে, বা শত্ৰু ছাড়া অন্য কেউ করেছে কিনা, তা বলতে পারব না।
আজ্ঞে না। এমনিই থিয়েটারে হগুপ্তায় তিন দিন দেখা হচ্ছে, তার উপর সে আমার এমন বন্ধু ছিল না যে অন্যদিনও দেখা করব।
যে দিন খুন হয় সেদিন সন্ধ্যাবেল আপনি কী করছিলেন?