কার্ড নিয়ে দেখি তাতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘লালমোহন গাঙ্গুলী, রাইটার।’
দিব্যি হয়েছে, আমি বললাম।
দারোয়ানের হাতে একটা কার্ড ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল, তিন মিনিটের মধ্যে আমাদের ডাক পড়ল।
কৈলাসবাবুকে দেখে মনেই হল না। আমাদের উনি চিনতে পেরেছেন। বেশ রুক্ষভাবেই বললেন, শুনুন, আমার এখানে এখন বিশেষ গোলমাল। আপনি যদি নতুন নাটক নিয়ে এসে থাকেন তো অন্য সময় হবে। এই কটা দিন বাদ দিন।
লালমোহনবাবু জিভ কেটে বললেন, নতুন নাটক নয়। স্যার; আমি এসেছি। প্রদোষ মিত্র প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের প্রতিভূ হয়ে। উনি অসুস্থ, তাই নিজে আসতে পারলেন না। উনি এর আগে মহীতোষ রায়ের ব্যাপারে একবার আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন আমিও এসেছিলাম ওঁর সঙ্গে।
হ্যাঁ–মনে পড়েছে। তা আপনি কী জানতে চাইছেন? খবরের কাগজে যা বেরিয়েছে তার বেশি কিছু বলার নেই।
একটা প্রশ্ন ছিল—নেপালবাবুও কি মহীতোষবাবুর মতো হুমকি চিঠি পেয়েছিলেন?
পেয়েছিল, তবে সে বিষয় প্রথম ক’দিন চেপে রেখেছিল। কোনও পাত্তা দেয়নি। তারপর তিনদিন আগে প্ৰথম আমাকে বলে। চিঠি পাচ্ছিল প্রায় দশদিন থেকে।
সে চিঠি আপনি দেখেছেন?
দু-তিনটে দেখেছি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। হুমকি চিঠি যেরকম হয় সেরকমই আরকী। আমি ওকে সাবধানে থাকতে বলি, কিন্তু নেপাল মঞ্চে হিরো সাজত বলে নিজেকেও একটা হিরো বলে মনে করত। সে বলে, এসব হুমকিতে আমি ঘাবড়াই না।
তিনি থাকতেন কোথায়?
নকুলেশ্বর ভট্টাচাৰ্য লেনে, সাতাশ নম্বর।
উনি কি বিবাহিত ছিলেন?
হ্যাঁ।
কাগজে লিখেছে উনি ওঁর এক বন্ধুর বাড়ি যাবেন বলে ট্যাক্সি থেকে নেমেছিলেন। এই বন্ধুটি কে আপনি জানেন?
গলিতে বাড়ি বলে যখন বলছে তখন শশধর চাটুজ্যে বলে মনে হয়। সেও অভিনেতা, রূপম থিয়েটারে অভিনয় করে।
অপ্সরা থিয়েটারে ওঁর কোনও শত্রু ছিল না?
সে আর আমি কী করে বলব বলুন। প্রধান অভিনেতাকে সকলেই ঈর্ষা করে। সে অর্থে শুধু আমাদের থিয়েটারে কেন, অন্য থিয়েটারেও নেপালের শত্রু ছিল। তাকে সরাতে পারলে আমার থিয়েটার কানা হয়ে যাবে এটা অনেকেই জানত।
আপনাদের থিয়েটার কি তা হলে এখন বন্ধ?
আজ প্রফুল্লর লাস্ট শো ছিল—সেটা আর হবে না। আমরা তো নতুন নাটক আলমগীর নামাব বলে তোড়জোড় করছিলাম। নাম ভূমিকায় তো নেপালেরই করার কথা ছিল। এখন অন্য অ্যাকটরকে ট্রাই করা হচ্ছে। একজন নতুন লোক এসেছে।
কেমন?
মন্দ নয় বোধহয়। দাড়ি গোঁফ নিয়ে আলমগীর সাজবার চেহারা নিয়ে চলে এসেছে। তার মেক-আপ লাগবে না।
এবার আমার একটা কথা মনে পড়ল। বললাম, এখানকার মেন অ্যাকটরদের বাড়ির ঠিকানাগুলো নিয়ে নিন। ফেলুদা হয়তো ওদের কারুর কারুর সঙ্গে কথা বলতে চাইবে।
হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ, বললেন লালমোহনবাবু।
কৈলাসবাবুকে বলতে আবার ঘণ্টা টিপে ওর সেক্রেটারিকে আনিয়ে আমাদের সব নাম ঠিকানাগুলো আনিয়ে দিলেন।
যেই বন্ধুর বাড়িতে সেদিন নেপালবাবু যাচ্ছিলেন, তিনি কোথায় থাকেন বলতে পারেন?
কাগজে দেখেননি? খুনটা হয়েছে মতি মিস্ত্রি লেনে। কাজেই তিনিও সেখানেই থাকতেন।
আমরা ভদ্রলোককে আর বিরক্ত না করে উঠে পড়লাম। একবার মতি মিস্ত্রি লেনে শশধর। চাটুজ্যের বাড়ি যাওয়া দরকার।
০৫. মতি মিস্ত্রি লেনে
মতি মিস্ত্রি লেনে তিনজনের বেশি লোক পাশাপাশি হাঁটতে পারে না। আমরা গাড়ি বড় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গলির দিকে এগোলাম। মোড়ে একটা পান বিড়ির দোকান। মালিককে জিজ্ঞেস করতে বলে দিল শশধর চাটুজ্যে তিন নম্বর বাড়িতে থাকেন।
তিন নম্বরের দরজায় টাকা মারতে একজন ভদ্রলোক দরজাটা খুললেন।
কাকে চাই?
আমরা শশধর চাটুজ্যের খোঁজ করছিলাম।
আমিই সেই লোক। আপনাদের প্রয়োজন?
লালমোহনবাবু একটা কার্ড বার করে দিতে ভদ্রলোকের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। আপনিই কি সেই বিখ্যাত রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীর লেখক?
লালমোহনবাবু একটু বিনয় করলেন।
বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই সেই লোক?
আরে বাবা। আপনার সব বই যে আমার পড়া। তা হঠাৎ এ-গরিবের বাড়িতে কী মনে করে?
আমি এসেছি আমার বন্ধু গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্রের তরফ থেকে।
তাঁর নামও তো শুনিচি! আপনারা ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন!
এতক্ষণে ঘরের ভিতর ঢুকলাম আমরা। একটা তক্তপোশেই প্রায় ঘরটা ভরে আছে, তবে তার সঙ্গে দুটো কাঠের চেয়ার রয়েছে।
লালমোহনবাবু চেয়ারে বসে বললেন, আপনার বন্ধুর খুনের ব্যাপারে আমরা তদন্ত করছি। সে সম্বন্ধে আপনি যদি কিছু বলেন।
আমি আর কী বলব। সে আমার বাড়িতে ঢোকার আগেই খুন হয়। পাড়ার একটি ছেলে আমাকে খবর দেয়। বাইশ বছর হল আমাদের বন্ধুত্ব, যদিও রাইভ্যাল থিয়েটারে আমরা অভিনয় করতাম।
ওঁর কোনও শত্রু ছিল বলে জানেন?
নেপালের শত্রু থাকবে না? সে এত বড় একটা হিরো-অন্য সব অভিনেতার সে ঈর্ষার পাত্ৰ। তার তো শত্ৰু থাকবেই।
বিশেষ কারুর নাম মনে পড়ছে না?
না। তা পড়ছে না। সেরকম কোনও নাম নেপাল করেনি। আমার কাছে। সে কাউকে বিশেষ তোয়াক্কা করত না। একটু বেপরোয়া গোছের লোক ছিল। তার পেশায় তার সমকক্ষ খুব কমই ছিল। অন্য বহু থিয়েটার তাকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়েছে। কিন্তু অপ্সরায় তার অভিনয় জীবনের শুরু বলে সে আর কোথাও যায়নি।
তিনি যে হুমকি চিঠি পাচ্ছিলেন সে কথা আপনাকে বলেছিলেন?