পথে নামা মাত্রই উন্মত্ত হিন্দু প্রতিবেশীরা তাঁকে মারার জন্য এগিয়ে এলেন। কেউ কেউ বললেন, ব্যাটাকে শেষ করে দাও। কোনওক্রমে রেহাই পেলেও তিনি জানেন না কোথায় আশ্রয়। তাঁর কোনও হিন্দু আত্মীয়স্বজন দরজা খুলে দিলেন না। পাশে এসে দাঁড়ালেন দক্ষিণারঞ্জন। আশ্রয় দিলেন নিজের বাড়িতে। এই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। The persecuted নামে পাঁচ অঙ্কের একটি নাটক লিখে ছাপিয়ে চতুর্দিকে বিতরণ করলেন। কৃষ্ণমোহন। নাটকে আক্রমণের লক্ষ্য হিন্দুদের ধর্ম, আচার, আচরণ, ব্যবহার। ডাক্তার ডফ আসরে নামলেন। ইংরেজি প্রবাদ আছে Strike the iron while it is hot কৃষ্ণমোহনকে বোঝাতে লাগলেন তোমার হিন্দুধর্ম পৃথিবীর একটি নিকৃষ্ট ধর্ম, সে তো দেখতেই পেলে। দক্ষিণারঞ্জন না থাকলে কোন হিন্দু তোমাকে আশ্রয় দিতেন? পৃথিবীর সেরা ধর্ম খ্রিস্টধর্ম। শহরে ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছে কৃষ্ণমোহন ও তার প্রাণের বন্ধু দক্ষিণারঞ্জন আর কয়েকদিনের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবে। কৃষ্ণমোহনের প্রচুর প্ররোচনা দক্ষিণারঞ্জনকে টলাতে পারল না। তিনি ডফের ফাঁদে পা দিলেন না। তাঁর নিজস্ব একটা অহংকার ছিল। তিনি হিন্দু–এই গর্ব তাঁকে পরিচালিত করত। তাঁর পিতার বংশ, তাঁর মাতামহের বংশ কত বড়।
কৃষ্ণমোহন দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে আশ্রিত। বাজারে প্রবল গুজব। দক্ষিণারঞ্জনের নিষ্ঠাবান পিতা পূজা, আহ্নিক শেষ করে বাইরের বাটিতে আসছেন। এমন সময় কেউ একজন এসে বললেন, দক্ষিণারঞ্জনের হয়ে গেল। সবে ঠাকুরঘর থেকে পুজো শেষ করে বৈঠকখানায়। এসেছেন, এমন সময় এই সংবাদ। দেখলেন কৃষ্ণমোহন সামনে, দক্ষিণারঞ্জন সেইসময়। বাড়িতে ছিলেন না। পা থেকে খড়ম খুলে তিনি কৃষ্ণমোহনকে ছুঁড়ে মারলেন। শুধু তাই নয়, তিরস্কার করলেন, কিছু অশালীন কথাও বললেন। বাইরে দরজার দিকে আঙুল তুলে বললেন, এখনই বেরিয়ে যাও। অপমানিত কৃষ্ণমোহন সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নামলেন। ইতিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জন ফিরে এসেছেন। শুনলেন, বন্ধু কৃষ্ণমোহনকে যা তা বলে বাবা দূর করে দিয়েছেন, এমনকী খড়ম ছুঁড়ে মেরেছেন। মর্মাহত দক্ষিণারঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে গৃহত্যাগ করলেন। তিনি অবশ্য পরে শান্ত হয়ে ফিরে এলেন। পিতার প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি ছিল। শান্ত জগন্মোহন, পড়ুয়া জগন্মোহন যদিও কিছু করতেন না কিন্তু এই রাজগৃহের নানা কোলাহলের মধ্যে তাঁকে থাকতে হত। তার ওপর সমাজের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থা। তিনি নিজেই গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন কাশীতে। আর ফেরেননি। সেইখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কাশীতে থাকাকালে দক্ষিণারঞ্জন প্রায়ই বাবার কাছে যেতেন। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসতেন। কলকাতায়।
ইংরেজরা বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। ১৮৩৫ সাল। স্যার চার্লস মেটকাফ, পরে লর্ড হয়েছিলেন। তিনি ভারতীয়দের ফ্রিডম অফ প্রেস অনুমোদন করলেন। এটি একটি বিরাট প্রাপ্তি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। তিনি বললেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এলে, মানুষ সোচ্চারে তার মনের কথা বলবে। এতে তাঁর জন্মগত অধিকার। কোনও সরকার তা কেড়ে নিতে পারে না। জ্ঞানান্বেষণ-এর সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার কথা প্রায়ই ভাবতেন। কলকাতার বহু ইংরেজি ও দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রের সম্পাদকগণ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা টাউন হলে সমবেত হয়ে মেটকাফকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন। একটি অভিনন্দনপত্র প্রদান করলেন। সভায় দক্ষিণারঞ্জন একটি হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দিলেন। লন্ডনের Alexanders Magazine-এ একটি চিঠি প্রকাশিত হল। সেই চিঠিতে ছিল এই সভার কার্য বিবরণী। দক্ষিণারঞ্জনের বক্তৃতাটিও প্রকাশিত হয়েছিল। বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, Sir Charles Metcalfe certainly deserves all the thanks that we are able to bestow on him, and I concur with Mr. Turton, that the liberty we require is not limited but absolute liberty under responsibility. Let the offender be amenable to the Law, and if he deserve punishment, a court of justice is the tribunal to inflict it. I am sorry that we have some cause of complaints against Lord William Bentinck, for not having passed the proposal law. It was his duty according to his oath, if he thought the present law good, to enforce it, if not, to repeal it. The proposal law is well calculated to promote the benefit of the country; for no country so much needs a free press as that whose Government is despotic.
ডিরোজিও স্থাপন করেছিলেন, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। তাঁর মৃত্যুর পর সেটি অবলুপ্ত হল। এই ধরনের সংস্থার প্রয়োজনীয়তা সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুবই আকাঙ্ক্ষিত। ডিরোজিওর বিশিষ্ট শিষ্যগণতারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ দে–এই পাঁচজন ১৮৩৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানপত্র প্রকাশ করলেন। স্বাক্ষরকারীদের প্রস্তাব সবরকমের জ্ঞান লাভ করার জন্য দেশের বিভিন্ন অবস্থার তথ্য সংগ্রহের জন্য, প্রীতি বজায় রাখার জন্য স্থাপিত হল সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ বা সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা। স্থাপিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক রামকমল সেনের অনুমতি নিয়ে ১২ মার্চ কলেজের সভাকক্ষে সকলে সমবেত হলেন, ১৬ মে থেকে সভার কাজ শুরু হয়ে গেল। অধিবেশনের জন্য নির্দিষ্ট হল প্রতিমাসের দ্বিতীয় বুধবার। সভ্যরা তাঁদের ইচ্ছামতো চাঁদা। দিতে পারেন। কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যাঁদের যাঁদের প্রবন্ধ পাঠ করতে বলা হবে তাঁরা যদি নির্দেশ পালন না করেন, সন্তোষজনক কারণ দেখাতে না পারেন তাহলে অর্থদণ্ড হবে। এই সভার পরিদর্শক হলেন ডেভিড হেয়ার। সম্পাদক হলেন দুই বিখ্যাত ব্যক্তি রামতনু। লাহিড়ী ও প্যারীচাঁদ মিত্র। দক্ষিণারঞ্জনের নাম কোনওভাবেই যুক্ত হল না। কারণ সেই। সময়ে তিনি কলকাতায় ছিলেন না। ফিরে আসার পর তিনি যোগদান করেন। পরে হয়ে। উঠলেন একজন প্রধান সভ্য। এইটাই স্বাভাবিক।