পাদরিদের হিন্দুধর্ম-বিদ্বেষ ডিরোজিওর শিষ্যদেরও গ্রাস করল। ঘৃণার ওপর ঘৃণা–যেন ডবল ডোজ। তাঁদের আচার-আচরণে ভয়ংকর রকমের একটা উগ্রতা দেখা দিল। যা অবশ্যই ছেলেমানুষির শামিল। যার একটি হল–নিষিদ্ধ মাংস চ্যালেঞ্জ করে খাওয়া। এইরকম একটা জটিল সময়ে দক্ষিণারঞ্জন হিন্দু কলেজের পাঠ সমাপ্ত করলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। অর্থের প্রতি অবশ্য তাঁর কোনও আসক্তি ছিল না। স্বদেশ কল্যাণে মুক্ত হস্তে দান করতেন। মাথায় ছিল একটি স্বদেশি সংবাদপত্রের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে জাতির জাগরণ ঘটানো যেতে পারে। কুসংস্কার মুক্ত একটি ধর্মের পক্ষে প্রচার জোরদার করা যায়। তিনি নিজেই প্রকাশ করলেন একটি সাপ্তাহিক পত্র, নাম জ্ঞানান্বেষণ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ। প্রায় তেরো বছর ধরে শিক্ষিত হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরিত হয়েছিল। সম্পাদক ছিলেন দুজন। দক্ষিণারঞ্জন ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক। তেরো বছরের সময়কালে পালা করে এক-একজন সম্পাদক হয়েছিলেন–যেমন প্যারীচাঁদ মিত্র, তারিণী বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামচন্দ্র মিত্র ও হরমোহন চট্টোপাধ্যায়। সুপণ্ডিত গোবিন্দচন্দ্র বসাক মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখতেন। প্রকাশের এক বছর পরে পত্রিকাটি হল দ্বিভাষী–ইংরেজি ও বাংলা। এই কাগজে প্রায়ই হিন্দুধর্মকে নানাভাবে আক্রমণ করা হত। হিন্দুধর্মের কুসংস্কারই ছিল আঘাতের লক্ষ্য। দক্ষিণারঞ্জনের পিতা জগন্মোহন নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু। তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। পিতার সঙ্গে পুত্রের বাদানুবাদ। দক্ষিণারঞ্জন অভিমানে গৃহত্যাগ করলেন। কোথায় যাবেন! সার্কুলার রোডে গুরু ডিরোজিওর বাড়ির পাশে একটি বাড়ি ভাড়া করলেন। অর্থের তো অভাব নেই। দক্ষিণারঞ্জন পিতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, ভালোবাসতেন। বেশিদিন ছেড়ে থাকা সম্ভব হল না। পিতা-পুত্রের আবার মিলন ঘটল। এই সময় ডিরোজিও উইলসনকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তাঁর প্রিয় ছাত্র দক্ষিণারঞ্জনের গৃহত্যাগের উল্লেখ আছে–দুই থেকে তিন মাস আগে দক্ষিণারঞ্জন আমাকে বলল, তার পিতার ব্যবহার ও আচরণ অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিছুতেই সমর্থন করা যাচ্ছে না। অতএব বাড়ি ছাড়তেই হবে। আমি জানতুম কী ঘটেছে। এও জানতুম সে সত্য কথা বলছে। কিন্তু আমি বলেছিলুম, তোমার গৃহত্যাগ আমি সমর্থন করি না। পিতার ব্যবহার যাই হোক না, সন্তানের সহ্য করা উচিত। তোমার প্রতিবাদ ও আচরণ জগৎ সমর্থন করবে না। তিনি তো তোমাকে চলে যেতে। বলেননি। তুমি স্বেচ্ছায় তাঁকে পরিত্যাগ করবে কেন! মনে হয়েছিল দক্ষিণারঞ্জন আমার যুক্তি মানবে। দুঃখের বিষয় কিছু দিনের মধ্যেই সে ধৈর্য হারিয়ে যা ভেবেছিল তাই করল। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে সে গৃহত্যাগ করল। অবাক হয়ে দেখলুম, আমারই এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে উঠে এসেছে।
৩. সময় শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, সময়ই শ্রেষ্ঠ পরিচালক
সময় শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, সময়ই শ্রেষ্ঠ পরিচালক। এ মনে হয় অস্বীকার করা যায় না। মাধুর্যের নাম এমিলিয়া। ডিরোজিওর সুশিক্ষিতা, স্নেহময়ী বোন। ভাই আর বোনের ছোট্ট সংসার। এমিলিয়া যেন ডিরোজিওর মা। ভাইটিকে স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। দক্ষিণারঞ্জনকেও ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। একই পাড়ায় দক্ষিণারঞ্জন এসেছেন। যখন তখন ডিরোজিওর বাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত। এক ধরনের মানুষ থাকেন যাঁরা চিরকালই অন্যের ছিদ্র অনুসন্ধান করেন, কুৎসা রটান। সব যুগেই তাঁরা বহালতবিয়তে থাকেন। শহরে রাষ্ট্র হয়ে গেল দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে ডিরোজিও পরিবারের ঘনিষ্ঠতা দেখে মনে হচ্ছে, গোপীমোহন ঠাকুরের নাতি এইবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন বলে। বড়লোক বাড়ির এইরকম একটি ছেলেকে পেলে পাদরিরা ধন্য হয়ে যাবেন। আর ওই এমিলিয়া, তাঁকেই বা বিশ্বাস কী! দুজনের এই ভালোবাসা প্রেমেরই নামান্তর। বিয়ে আসন্ন। এই কুৎসার কোনও ভিত্তি ছিল না। দক্ষিণারঞ্জন অনেক আগেই ডাক্তার ডফের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে কেউই অতটা কাছাকাছি যেতে পারেননি। ডফ সাহেব নিশ্চয়ই পারলে দক্ষিণারঞ্জনকে অনেক আগেই খ্রিস্টান করে দিতেন। আর এমিলিয়ার সঙ্গে বিবাহ? অনেক আগে ছাত্রাবস্থায় দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে হরচন্দ্র ঠাকুরের কন্যা জ্ঞানদাসুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেছে। এমিলিয়া অত্যন্ত পবিত্র স্বভাবের মেয়ে ছিলেন। বিবাহিত দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে অবৈধ প্রেমের কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। স্বল্প পরমায়ুর ডিরোজিও আজীবন অবিবাহিত ছিলেন। বোন এমিলিয়া অনেক চেষ্টা করেছেন দাদাকে বিবাহে রাজি করাতে। একটি ইংরেজি কবিতায় ডিরোজিও এমিলিয়াকে লিখেছিলেন যে কথা তার কোনও তুলনা নেই। সেই কবিতায় এমিলিয়ার নির্মল চরিত্রের বর্ণনা আছে।
কলকাতার সমাজে এখন হিন্দু ধর্মের কয়েকজন গোঁড়া সমর্থক খুবই প্রবল। তাঁদের একজন হলেন কেশবচন্দ্র সেনের পিতামহ দেওয়ান রামকমল সেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিওকে সরাবার প্রস্তাব করেন। কলেজের হিন্দু অধ্যক্ষরা ডিরোজিওর নামে তিনটি অপবাদ এনেছিলেন। প্রথম হল–ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি, পিতা মাতার প্রতি অবহেলা করতে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া, তিন নম্বরটি খুবই সাংঘাতিক। ভ্রাতা। এবং ভগিনীর বিবাহ অনুমোদন করা। ডাক্তার উইলসন আগেভাগেই ডিরোজিওকে এই খবর দিলেন–তোমাকে ওরা অপসারিত করতে চাইছে। ডিরোজিওর আত্মসম্মান অত্যন্ত প্রবল। তিনি কারও পরোয়া করেন না। তাঁর জীবনে প্রতিফলিত করতে চাইছেন উচ্চ একটি আদর্শ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ, ২০ এপ্রিল, একটি চিঠিতে ডিরোজিও নিজেই পদত্যাগ করলেন। তিনটি অপবাদ অস্বীকার করে উইলসনকেও একটি চিঠি লিখেছিলেন। ডিরোজিওর পদত্যাগে তাঁর ছাত্ররা বজ্রাহত। তাঁরা এই অনন্য শিক্ষকের, তাঁদের প্রাণের মানুষটির আরও কাছে সরে এলেন। এরপর তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন, এই ছাত্রগোষ্ঠী নিয়মিত তাঁর কাছে যেতেন, তাঁর উপদেশ অনুসারেই জীবন গঠনের চেষ্টা করতেন। ১৮৩১ সাল, ডিরোজিওর জীবনের একটি ঘনায়মান কাল। ২৩ ডিসেম্বর মাত্র তেইশ বছর বয়সে ওলাওঠা রোগে পৃথিবী ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। অসুস্থ অবস্থায় যাঁরা প্রাণ দিয়ে সেবা করেছিলেন তাঁদের একজন হলেন দক্ষিণারঞ্জন। ডিরোজিও শূন্য কলকাতা। দক্ষিণারঞ্জন এই সময়ে অতি উচ্চভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ধনী কিন্তু ভীষণ অমায়িক, পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল। একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক যেন। এই চরিত্রের পরিচয় ছড়িয়ে আছে তাঁর শৈশব জীবনের কয়েকটি ঘটনায়। একটি হল– দক্ষিণারঞ্জনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী। তিনি একবার ব্যবসায় প্রচুর টাকা লোকসান করলেন। প্রচুর ঋণ। দক্ষিণারঞ্জন তখন কৈশোর অতিক্রম করতে চলেছেন। তাঁর কানে এল এই সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে নাম প্রকাশ না করে বন্ধুকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। বহুদিন পরে তারাচাঁদ যখন তাঁর উপকারীর নাম জানতে পারলেন তখন ঋণ স্বীকার করে ওই টাকাটি শোধ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলেন। যুবক দক্ষিণারঞ্জন শুনলেন, হেয়ার সাহেব অর্থের প্রয়োজনে অত্যন্ত বিব্রত। সমাজসংস্কারে তিনি প্রায় নিঃস্ব। দক্ষিণারঞ্জন তাঁকে। অবিলম্বে ষাট হাজার টাকা ধার দিলেন। হেয়ার সাহেব যখন দেখলেন শোধ করার কোনও ক্ষমতাই তাঁর নেই অথচ এই প্রবল অস্বস্তি। দক্ষিণারঞ্জন তখন বললেন, ঠিক আছে, আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন। হেয়ার সাহেব এক খণ্ড জমি দক্ষিণারঞ্জনকে লিখে দিলেন। যার মূল্য মাত্র আট হাজার টাকা। দক্ষিণারঞ্জন বললেন, সব শোধ। তৃতীয় ঘটনাটি আরও জটিল। এই ঘটনার নায়ক দক্ষিণারঞ্জনের বন্ধু কৃষ্ণমোহন। ডিরোজিওর শিক্ষায় তিনি কিছুটা বেসামাল। কৃষ্ণমোহনের বাড়ির উত্তর দিকের একটি বাড়িতে থাকতেন ভৈরবচন্দ্র ও শম্ভুচন্দ্র চক্রবর্তী। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। একদিন কৃষ্ণমোহন যখন বাড়িতে নেই সেই সময় তাঁর। কয়েকজন বন্ধু এসে হাজির। যথারীতি বৈঠকখানায় বসে তাঁরা সমাজসংস্কার বিষয়ে আলোচনা করতে করতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। একজন চলে গেলেন মুসলমানের দোকানে। সেখান থেকে গোমাংসের তৈরি খাদ্য নিয়ে এলেন। কৃষ্ণমোহন তখন নেই। ঘরে বসে খাওয়া হল। এরপর উচ্ছিষ্ট অংশ প্রতিবেশী চক্রবর্তীদের বাড়ির দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করতে লাগলেন–ওই গো হাড়, ওই গো মাংস। শম্ভুবাবু তখন বাড়িতে ছিলেন। ভৈরববাবু ছিলেন না। শম্ভুবাবু প্রতিবাদ করলেন। কাজ হল না। তখন তিনি কয়েকজন প্রতিবেশীকে নিয়ে মার মার করে তেড়ে এলেন। যুবক দল ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেলেন। কৃষ্ণমোহনের দাদা ভুবনমোহন বাড়িতে আসা মাত্রই প্রতিবেশীদের নালিশ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হুকুম দিলেন, কৃষ্ণমোহন এই বাড়িতে যেন আর না ঢোকে। প্রতিবেশীরা বলেছেন, কৃষ্ণমোহনকে না তাড়ালে তাঁরা বাড়ি ভেঙে দেবেন। ভাইকে তাড়াতে বাধ্য হলেন ভুবনমোহন। কৃষ্ণমোহন এসবের কিছুই জানেন না। বাড়ি ফেরা মাত্রই শুনলেন, এই বাড়িতে তাঁর কোনও স্থান নেই। কৃষ্ণমোহন যে ছিলেন না, তিনি কিছুই জানেন না–এসব কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি নিঃশব্দে চিরবিদায় নিলেন।