দক্ষিণারঞ্জন হিন্দু কলেজে। আর সেখানে একজন অসাধারণ শিক্ষক–হেনরি লুই ভিভিয়ান। ডিরোজিও। তাঁর শিক্ষা প্রণালী ছিল অতি বিচিত্র। ছাত্রদের ওপর অসামান্য প্রভাব। বয়সে তিনি তরুণ, কিন্তু প্রতিভায় বিচ্ছুরিত। ডিরোজিও মনে করতেন, শুধু ভাষায় পারদর্শী হলে হবে না, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। মেধার সঙ্গে হৃদয়ের যোগ ঘটাতে হবে। ছাত্রদের বলতেন, ভাবতে শেখো। এই দেশ প্রাচীন সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এই অন্ধকার থেকে বেরোতে হবে। ডিরোজিও মনস্তত্ব ও নীতিশাস্ত্রে উন্নত ছিলেন। ছাত্রদের এই দুটি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ধৈর্য অসাধারণ। ছাত্রদের নিয়েই পড়ে থাকতেন।
সেই সব ইউরোপীয় দার্শনিকদের কথা বেশি করে বলতেন যাঁদের চিন্তায় মানুষই প্রাধান্য পেত। এইসব দার্শনিক হলেন লক, রিড, স্টুয়ার্ট ব্রাউন প্রমুখ। ছাত্রদের তিনি পর্যবেক্ষণ শক্তি বাড়াতে বলেছিলেন। উৎসাহ দিতেন ডিবেটে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য বই পড়তে বলতেন। সুযোগ পেলেই নিজের বাড়িতে বা অন্য জায়গায় তর্কসভার আয়োজন করে ছাত্রদের নিয়ে বসতেন। ছাত্ররাই ছিলেন তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। নিজে ছিলেন কবি। দীর্ঘ একটি কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন–
অৰ্দ্ধস্ফুট পুষ্পদল সম, ধীরে ধীরে হয় বিকশিত
তোমাদের সুকুমার চিত, হেরি আমি উৎসুক নয়নে;
মানসিক শক্তিচয় যেন ছিল মন্ত্রমূর্হিত শয়নে,
সুবৰ্ণ–শলাকা–স্পর্শে এবে ক্রমে ক্রমে হয় উদ্বোধিতা।
ডিরোজিওর শিক্ষাপ্রণালী এতটাই অভিনব ছিল যে, গতানুগতিক শিক্ষকরা ধরতেই পারতেন না কী হচ্ছে। হিন্দু কলেজের শিক্ষকদের প্রতিমাসে প্রধান শিক্ষকের কাছে ছাত্রদের প্রগ্রেস রিপোর্ট জমা দিতে হত। ডিরোজিও এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ছাত্রদের আত্মবিকাশের দিকেই তাঁর নজর ছিল। সেই সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন ডি. আনসেলম। ডিরোজিওর রিপোর্ট তাঁর পছন্দ হত না। একবার তিনি এতটাই রেগে উঠলেন যে, ডিরোজিওকে প্রহার করার জন্য হাত ওঠালেন! ডিরোজিও পিছনে সরে গিয়ে সেই আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচান। তাঁকে ঘিরে একটি ছাত্র গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তাঁরা ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে সচেষ্ট হলেন।
ডিরোজিও একটি ছাত্রসভা স্থাপন করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। দক্ষিণারঞ্জন এই সভার সভ্য ছিলেন। ডিরোজিওর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন আর-এক বিদেশি–হেয়ার সাহেব। এই হেয়ার সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সাহেবের সংবর্ধনার জন্য ডিরোজিওর ছাত্ররা উৎসাহী হলেন। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অনন্য প্রচেষ্টা সকলের মুখে মুখে। মাধবচন্দ্রমল্লিক তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একটি পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। আলোচনার বিষয়–ডেভিড হেয়ারের সংবর্ধনা। দুটি সভা হল। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ ২৮ নভেম্বর প্রথম সভা। উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৩১ সালের ৩০ জানুয়ারি দ্বিতীয় সভা। সভাপতি রসিককৃষ্ণ মল্লিক। দুটি সভাতেই বক্তৃতা করলেন কৃষ্ণমোহন, রসিককৃষ্ণ, দক্ষিণারঞ্জন, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ কয়েকজন। সিদ্ধান্ত হল চাঁদা করে হেয়ার সাহেবের একটি তৈল চিত্র আঁকা ও সেই ছবি প্রতিষ্ঠিত হবে উপযুক্ত স্থানে।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ ১৭ ফেব্রুয়ারি। ডেভিড হেয়ারের জন্মদিন। হেয়ার স্কুলে তাঁর সংবর্ধনা। দক্ষিণারঞ্জনের নেতৃত্বে হেয়ারের অসংখ্য ছাত্র সেই সভায় মিলিত হলেন। সুন্দর একটি অভিনন্দন পত্র পাঠ করে তাঁর হাতে দেওয়া হল। দক্ষিণারঞ্জন অসাধারণ একটি বক্তৃতা দিলেন। এই বক্তৃতাতেই হেয়ার সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত উক্তি–আপনি আমাদিগকে জননীর ন্যায় স্তন্য দিয়াছেন।হেয়ার সাহেব মাথাটি ধীর ভাবে নাড়তে নাড়তে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। দক্ষিণারঞ্জনের চেষ্টায় চিত্রকর চার্লস পোট ডেভিড হেয়ারের সুন্দর একটি তৈলচিত্র সযত্নে আঁকলেন। ছবিটি হেয়ার স্কুলে আছে। ওই ছবির পাশে একটি বালকের প্রতিকৃতি। বালকটি আর কেউ নন, তাঁর প্রিয়তম শিষ্য দক্ষিণারঞ্জন।
ডিরোজিও তখন হিন্দু সমাজের পক্ষে ভয়ংকর এক সমস্যা। তিনি যে সভা স্থাপন করেছিলেন সেই সভায় ধর্ম ও সমাজ সংস্কার নিয়ে অগ্নিগর্ভ সব আলোচনা হত। প্রথম সারির সদস্যরা, কৃষ্ণমোহন, রামগোপাল, দক্ষিণারঞ্জন আর রসিককৃষ্ণ। তাঁরাই প্রধানত আলোচনা করতেন। সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তিও আসতেন–তদানীন্তন চিফ জাস্টিস স্যার এডওয়ার্ড রায়ান, লর্ড উইলিয়ামস বেন্টিঙ্কের প্রাইভেট সেক্রেটারি কর্নেল বেনসন, কর্নেল বিটসন, পরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হয়েছিলেন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডরু এইচ মিল। তাঁরা এসে তরুণদের উৎসাহ দিতেন। তরুণরা অতি উৎসাহের ফলে হিন্দুধর্মের প্রতি ভয়ংকর অবজ্ঞা ও অশালীন আচরণ করতে শুরু করলেন। পারলে শাস্ত্র ও শাস্ত্রবিধিকে প্রকাশ্যে লাথি মারবেন, এইরকম একটা উচ্ছঙ্খলতা।
পাদরিরা দেখলেন, এই হল খ্রিস্টধর্ম ঢোকাবার সুবর্ণ সুযোগ। উঠে পড়ে লেগে গেলেন ডাক্তার ডফ ও আর্চ ডিকন ডিয়্যালট্রি। তাঁরাও অতি উৎসাহে ধর্মপ্রচারকদের বলতেন, কলেজের পাশেই সকাল, সন্ধ্যা পথসভা করে হিন্দুধর্মকে গালাগাল দাও আর খ্রিস্টধর্মের জয়গান করো, একদিকে ডিরোজিওর ছেলেরা ও অন্যদিকে পাদরিরা। খেলা খুব জমে উঠল।