কলকাতায় তাঁর নাম হল জগন্মোহন। পরমানন্দ আর কেউ বললেন না। নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটাও খুব মজার। সেকালে এই ঠাকুর পরিবারের নিয়ম ছিল বাড়ির জামাইয়ের নাম বাড়ির মেয়েদের পছন্দ না হলে তাঁরা তা পালটে দিতেন। পরমানন্দ নামটি মহিলাদের পছন্দ হয়নি। তাঁর স্ত্রী স্বামীর নাম বলতে গিয়ে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতেন। পরমানন্দের মধ্যে পরমান্ন শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। স্বামীর নাম উচ্চারণ করা অত্যন্ত দোষের। অতএব পরমান্ন বলা যায় না, নাম পালটাও। অতি সুন্দর পুরুষ পরমানন্দ, নাম রাখা হল জগন্মোহন।
অনেক পরে এই পরিবারের একটি মামলায় আলিপুর কোর্টে সাক্ষ্য দিতে উঠেছিলেন মহারাজা স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। তিনি গোপীমোহন ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র হরকুমার ঠাকুরের সন্তান। সাক্ষ্যদানকালে তিনি বলেছিলেন, আমার জ্যাঠামশাইয়ের নাম সূর্যকুমার ঠাকুর। আমি শুনেছি যাঁর নাম পরমানন্দ তাঁরই পরিবর্তিত নাম জগন্মোহন। জগন্মোহনের পিতার নাম ভৈরবচন্দ্রমুখুজ্যে। জগন্মোহনের ভাই ছিল কি না জানি না! তিনি বিবাহের আগে উচ্চবর্ণের কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। আমাদের ফ্যামিলির নিয়ম ছিল যে, ভালো কুলীন দেখে বিবাহ দেওয়া। ভৈরবচন্দ্রের সঙ্গে আগে আমাদের কোনও কুটুম্বিতা ছিল না। এই বিবাহে প্রথম হল। আমাদের ঠাকুরদার ফ্যামিলিতে নিয়ম ছিল, ভালো কুলীনের ছেলে এনে। আমাদের ফ্যামিলিতে বিবাহ দেওয়া এবং ভালো করে প্রভিশন করে দেওয়া। জগন্মোহনের সময় এইরকমই হয়েছিল। আমার পিতামহ গোপীমোহন ঠাকুর জীবিত থাকার সময় এই বিবাহ হয়।
পরমানন্দের দুর্গাদাস নামে এক ভ্রাতা ছিলেন। খড়দহের বিখ্যাত গোস্বামী বংশেবিবাহ করে সেখানেই বাস করতেন। পরমানন্দ সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। দুটি ভাষার গ্রন্থই পাঠ করতেন। লেখাপড়াতেই সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন। অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখা। পুঁথি লিখতেন।
সূর্যকুমারের কোনও পুত্রসন্তান হয়নি। দুটি কন্যা। পরমানন্দ প্রথমে ত্রিপুরাসুন্দরীকে বিবাহ করেছিলেন। সন্তান দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। কালে এই দক্ষিণারঞ্জনই হয়ে উঠবেন ইতিহাস বিখ্যাত এক মানুষ। সূর্যকুমার অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। একটি সওদাগরি ব্যাংকের প্রধান অংশীদার। পরিচালনার কাজে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। পিতা গোপীমোহনের সমস্ত জমিদারির তত্বাবধান করতেন। এক ইউরোপীয়, নাম স্মিথ, একটি ডক ইয়ার্ড নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। স্মিথ সাহেব একটি সমবায় স্থাপন করে গোপীমোহনের সাহায্য চান। তিনি প্রচুর অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেন। সূর্যকুমার এই সমবায়ের বেনিয়ান নিযুক্ত হন। পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে গেল। গোপীমোহনের সমস্ত টাকা জলে। সূর্যকুমার খুব অল্প বয়েসে মারা যান। মাত্র ত্রিশ বছর। ত্রিপুরাসুন্দরী পরমাসুন্দরী ছিলেন। তাঁর অনেক গুণ ছিল। দুর্ভাগ্য এই দক্ষিণারঞ্জনের জন্মের অল্পকাল পরেই তিনি মারা গেলেন। একেবারে শৈশবেই মাতৃহীন। পরমানন্দ সূর্যকুমারের দ্বিতীয় কন্যাশ্যামাসুন্দরীকে বিবাহ করলেন। শ্যামাসুন্দরীর স্নেহ ও যত্নে দক্ষিণারঞ্জনের কোনও সময়েই মনে হয়নি যে তাঁর মা নেই। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভেই চারটি সন্তান কালিকারঞ্জন, বিশ্বরঞ্জন, নিরঞ্জন, সর্বরঞ্জন।
এই কাহিনির নায়ক দক্ষিণারঞ্জন। কলকাতার বিখ্যাত রাজবাড়িতে যিনি বড় হচ্ছেন। পিতা জগন্মোহন জানতেন ইংরেজের ভারতে ইংরেজি না শিখলে ভবিষ্যতে কিছুই করা যাবে না। দক্ষিণারঞ্জন ভরতি হলেন হেয়ার সাহেবের স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই হল। এরপর হিন্দু কলেজ। ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন করেননি। করেছিলেন কয়েকজন দূরদর্শী হিন্দু। কলকাতার কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দান ও আন্তরিক চেষ্টায়, সর্বোপরি ডেভিড হেয়ার ও স্যার হাইড-এর সহযোগিতায় স্থাপিত হয়েছিল হিন্দু কলেজ। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। এ দেশীয় যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহারাজা স্যার
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। অন্যান্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন। বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর, গোপীমোহন ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ জয়কৃষ্ণ সিংহ, স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের পিতা গোপীমোহন দেব, আর গঙ্গানারায়ণ দাস। রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ও দক্ষিণারঞ্জনের খুল্লমাতামহ চন্দ্রকুমার ঠাকুর হিন্দু কলেজে প্রথম গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন। কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য হলেন গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ ও গঙ্গানারায়ণ দাস। জাস্টিস অনুকূল মুখোঁপাধ্যায়ের পিতা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রথম। সম্পাদক। পরিদর্শক হিসাবে নিযুক্ত হলেন ডেভিড হেয়ার ও ডাক্তার হোরেস হেম্যান উইলসন।
দক্ষিণারঞ্জনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অসাধারণ মেধা আর অদ্ভুত অধ্যবসায়। শিক্ষকরা বিস্মিত হতেন। এই ছেলেটিকে হেয়ার সাহেব পুত্ৰাধিক স্নেহ করতেন। ডাক্তার উইলসনও তাঁর প্রশংসা করতেন। বিখ্যাত কৃষ্ণদাস পাল, বাগ্মী, স্বদেশহিতৈষী রামগোপাল ঘোষের জীবনচরিতে স্বীকার করেছেন নীচের ক্লাসে পড়ার সময় দক্ষিণারঞ্জন ও রামগোপাল ইংরেজিতে এতটাই পারদর্শী হয়েছিলেন যে প্রবন্ধ লিখতেন। আর ডাক্তার উইলসন সেইসব লেখা ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের দেখিয়ে বলতেন, পড়ে দেখো, তোমাদের চেয়ে নীচের ক্লাসের দুই ছাত্র কী অসাধারণ লিখেছে। তোমরা এদের ধারে কাছে যেতে পারবে কি! দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে যাঁরা পড়তেন পরবর্তীকালে তাঁরাও বিখ্যাত হয়েছিলেন। যেমন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষের কথা তো বলাই হয়েছে। রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু। লাহিড়ি, রাধানাথ শিকদার। তাঁদের মধ্যে অনন্য ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। পরবর্তী জীবনে সেই পরিচয় পাওয়া যাবে।