ইতিহাসের কত কী বলার থাকে। নায়ক তো একজনই–কাল। আবার কাল শব্দটির আর এক অর্থ–অতীত। অনেক সুতো গোটানো লাটাই হাতে অদৃশ্য মহানায়ক বসে আছেন। সুতো ছেড়েই যাচ্ছেন, ছেড়েই যাচ্ছেন। একশো, দুশো, পাঁচশো বছর কিছুই নয়। এই। সেদিন। অতীত কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হত বঙ্গে বর্গি। সে কোন কাল?কত কাল?
১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় দশ বছর স্থায়ী বিকট এক উৎপাত। বর্ধমানের মহারাজা তিলোকচাঁদ তাঁর রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের খাস পতিত জমিরই বিরাট একটা অংশ কাউগাছি। বেশ নিরাপদ। পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্ব দিকে ঘন জঙ্গল ঘেরা বর্তির বিল। দক্ষিণে একটি খাল–নোয়াই খাল, উত্তরে মুক্তাপুরের খাল। দুটি খালই ভাগীরথীর সঙ্গে সংযুক্ত। মূলাজোড়ের অধিবাসী রামদেব নাগ, জায়গাটির সন্ধান দিলেন। গড়ে উঠল বর্ধমান রাজের বিকল্প রাজধানী। অবশ্যই বিশাল ব্যাপার। হাতি, ঘোড়া, লোক-লস্কর, পাইক-বরকন্দাজ। স্থানটির চেহারা ফিরে গেল।
বর্ধমান রাজপরিবার চিরকালই শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুরাগী পৃষ্ঠপোষক। কাউগাছিতে এসেই রাজমহিষী কৃষ্ণকুমারী জানতে পারলেন, পাশেই মূলাজোড় গ্রাম, সেখানে বাস করছেন বিখ্যাত কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। কৃষ্ণকুমারী আলোকিত রমণী, গুণী, ধর্মপ্রাণ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ কবিকে ১৬ বিঘা জমি দান করেছিলেন! কৃষ্ণকুমারীর মনে হল লোক-লস্কর, অশ্ব গবাদি নিয়ে এই রাজপরিবারটি যেন কবির ঘাড়ে এক মহা উৎপাতের মতো এসে পড়েছে। কবির শান্তি নষ্ট করছে। ভারতচন্দ্র শুধু কবি নন, সাধক। তাঁকে আরও পরিসর দিতে হবে। তিনি যুগোত্তীর্ণ মানুষ। মহারানি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে একটি চিঠিতে অনুরোধ জানালেন, আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। কথা আছে। জরুরি কথা। ভদ্র কৃষ্ণচন্দ্র এলেন। কৃষ্ণকুমারী ভারতচন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে বললেন, মহারাজ! ১৬ বিঘা পরিসর তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমরা পাশে এসে পড়ায় উৎপাত বেড়েছে। মূলাজোড় গ্রামটি আমাকে পত্তনি দিন। কৃষ্ণচন্দ্র খানিক চিন্তার পর বললেন, বেশ, ওই ষোলো বিঘা বাদ দিয়ে। আরও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, কৃষ্ণচন্দ্র আনারপুরের গুস্তেগ্রামে কবিকে ১২১ বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করবেন। কৃষ্ণকুমারী তখন নিজের নামে নয় তাঁদের অমাত্য রামদেব নাগের বেনামে পত্তনি পাট্টা সম্পাদন। করলেন। এই কাহিনিতে রামদেবের প্রবেশ এইভাবে। রাজারাজড়ার ব্যাপার। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়; আবার রাজায় রাজায় অনেক ভালো কাজও হয়।
বর্ধমানের অস্থায়ী রাজধানী এক সময় আবার বর্ধমান ফিরে গেল। গোপীমোহন নির্মাণ করলেন কাঙ্ক্ষিত দেবালয়। মূলাজোড়ে শুরু হল আর এক ইতিহাস। ভট্টপল্লির পরেই মূলাজোড় হল সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র। গোপীমোহন স্থাপন করলেন সংস্কৃত কলেজ, গ্রন্থাগার, দাঁতব্য চিকিৎসালয়। সংস্কৃত কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ভট্টপল্লির প্রখ্যাত নৈয়ায়িক শিবরাম সার্বভৌম। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠল এক মহামণ্ডলী। ন্যায়শাস্ত্রের এই ধারা বিখ্যাত হল মূলাজোড় সম্প্রদায় নামে।
ভট্টপল্লির নাম কয়েকবার করা হল। কোনও অদৃশ্য শক্তি কী ভট্টপল্লির এক নিষ্ঠাবান পরিবারকে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের দিকে ঠেলছে? হয়তো তাই! ভাটপাড়ার এক প্রাচীন মুখোপাধ্যায় বংশ। কৌলীন্যে তাঁরা ফুলের মুখুটি। ভরদ্বাজ গোত্র। শ্রীহর্ষের বংশ, ফুলেমেল। বহুঁকাল আগে ভাটপাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন গঙ্গাধর ঠাকুর। পরপর একাধিক পুরুষ–গঙ্গাধর, রামভদ্র, শুকদেব, হৃদয়রাম, ভবানীশঙ্কর, ভৈরবচন্দ্র। ভৈরবচন্দ্রে স্থির হব। তাঁর সন্তান পরমানন্দ। অন্য নাম জগন্মোহন। ভৈরবচন্দ্রইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। হিজলিকাঁথির লবণকুঠির সদর আমিন ছিলেন। এই জীবিকায় কোম্পানির আমলে বড়লোক হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। ভৈরবচন্দ্র তাই হলেন। অর্থের সঙ্গে সামাজিক প্রতিপত্তিও আসে। পার্সি ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। লোকে রসিকতা করে বলতেন, মৌলবি মুখুজ্যে। তিনি কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। তাঁর জীবনকালে মুখুজ্যেবংশের কুলভঙ্গ হয়নি। যা হল সব তাঁর মৃত্যুর পরে।
ভৈরবচন্দ্রের পুত্র পরমানন্দ রূপবান এক যুবক। অন্যদিকে গোপীমোহন ঠাকুরের বড়ছেলে সূর্যকুমার। তাঁর দুই মেয়ে ত্রিপুরাসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী। ঠাকুর পরিবারে নিয়ম ছিল সত্বংশে স্বাস্থ্যবান, রূপবান ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া। পরমানন্দের এক কাকা কলকাতায় যেতেন তাঁর কাজকর্মের জন্য। সেখানেই তাঁর বেশিরভাগ সময় থাকা। ঠাকুর পরিবারে তাঁর যাতায়াত ছিল। সূর্যকুমার একদিন পরমানন্দের খুল্লতাতকে বললেন, বড়মেয়ের বিয়ে দেব। সংশের সুচরিত্র ও সুপুরুষ একটি পাত্রের সন্ধান দিতে পারলে তোমাকে আমি পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব। পরমানন্দের খুড়ো সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললেন। পাঁচ হাজার টাকা কী কম কথা! আর পাত্র তাঁর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁর নাম পরমানন্দ। সমস্যা একটাই, তাঁর বিধবা জননী এই বিবাহ কিছুতেই সমর্থন করবেন না। কারণ কুলমর্যাদার হানি হবে। ঠিক আছে! কৌশল করতে। হবে। পরমানন্দের মাকে তিনি বললেন, কলকাতায় পার্বণ উপলক্ষে কালীঘাটে মহাসমারোহ হবে। পূজা-হোম-আমোদ-প্রমোদ। আমার খুব ইচ্ছে পরমানন্দকে একবার দেখিয়ে আনি। পরমানন্দের মা অতি সরল, তাঁর কোনও সন্দেহই হল না। তিনি বললেন, বেশ তো। খুড়োমশাই পরমানন্দকে নিয়ে সোজা চলে গেলেন সূর্যকুমারের বাড়িতে। বললেন, এই নিন পাত্র। পাঁচ হাজার টাকা পকেটে পুরে তিনি বিদায় নিলেন। সেকালের জমিদাররা যেভাবে জোর করে বিয়ে দিতেন সেই পদ্ধতিই শুরু হল। সেইদিনেই গায়ে হলুদ। বালক পরমানন্দ ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন। সূর্যকুমার বহু মূল্য অলংকারাদি দিয়ে পরমানন্দকে ভুলিয়ে রাখলেন। সেই সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি পরমানন্দের বিবাহ হল ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে। যথাসময়ে পরমানন্দের আত্মীয়স্বজনরা সব জানতে পারলেন। ভাটপাড়া থেকে তাঁদের চলে আসতে হল কলকাতায়। ইতিমধ্যে ঠাকুর পরিবারের জাঁকজমক, ঐশ্বর্য, আদর-আপ্যায়নে তাঁরা মোহিত। পরমানন্দ হলেন কলকাতার ঠাকুর পরিবারের ঘরজামাই।