বড় ইতিহাসের আড়ালে ছোট ছোট ইতিহাসও থাকে। মূলাজোড়ের কথা বলতে গিয়ে এসব প্রসঙ্গ আসছে কেন? কারণ একটাই, কোনও ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে একক থাকতে পারে না। গোপীমোহন ব্রহ্মময়ীর নির্দেশে মূলাজোড়ে মন্দির স্থাপন করবেন। অনেকটা জায়গা চাই। নদীর বাঁকে বিগ্রহটি বসেছিলেন ইঙ্গিত বহন করে। এই সেই স্থান। স্থান কোথায়! এ তো জলা আর জঙ্গল। ত্রিসীমানায় কোনও মানুষ নেই। এর চেয়ে শ্মশান যে ছিল ভালো।
অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, এই মূলাজোড় স্থানটি একসময় বিরাট কুখ্যাত জঙ্গলের একটি দিক। জঙ্গলটির নাম জয়চণ্ডীর জঙ্গল। তৎকালীন সীমানা ছিল এইরকম–উত্তরে প্রাচীন নদী বন্দর নবহট্ট, এখন যার নাম নৈহাটি। দক্ষিণে বর্তমানের বারাকপুর পর্যন্ত। এই জঙ্গলেরই বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ছিল বর্তির বিল। দীর্ঘকাল ধরে এই জঙ্গলে আচার অনাচার উভয়ই চলছিল পুরোদমে। একদিকে কাঁপালিক আর অঘোরীদের হাড়হিম করা যত কাণ্ডকারখানা, আর অন্যদিকে কুখ্যাত সব ডাকাতের দল। এই উভয় সম্প্রদায়েরই লোক সমাজে বিচরণের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এই কাঁপালিকরা নরবলি দিতেন আর ডাকাতরা ডাকাতির আগে এই নরবলিতে উৎসাহ দিত। এই ধারা থেকেই মা কালীর আর একটি রূপ প্রকাশিত হল–ডাকাত কালী। এই অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়চণ্ডী। সেই কারণেই বলা হত জয়চণ্ডীর জঙ্গল। এই দেবী কাঁপালিক ও ডাকাতদের দ্বারা পূজিত হতেন। গঙ্গার তীরে অবস্থান, তীরে বাঁধা থাকত দ্রুতগামী ছিপ। ডাকাতদের বাহন। গঙ্গার বুকে ডাকাতি করে নোয়াই খাল অথবা মুক্তাপুরের খাল ধরে এই অরণ্যে এসে আত্মগোপন করে থাকত। প্রয়োজন হলে জলপথেই পালাত।
হুসেন শাহের রাজত্বকালে দেশে শাসন ব্যবস্থার উন্নতি হল। পলাশির যুদ্ধের পর শুরু হল প্রকৃত সুশাসন। কাঁপালিক, অঘোরী, ডাকাত সব উধাও। জয়চণ্ডীর জঙ্গল ক্রমশ ছোট হতে লাগল। চারপাশে শুরু হল সাধারণ মানুষের বসবাস। ডাকাত আর কাঁপালিকরা পালাবার সময় অষ্ঠধাতু নির্মিত মা জয়চণ্ডীর মূর্তিটি বিলের জলে বিসর্জন দিয়ে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপিত হয়। বহু মানুষের বিশ্বাস এই দেবী জাগ্রত, মানুষের কল্যাণসাধন করেন। চতুর্দিক থেকে মানুষ আসেন উৎসবে শামিল হতে। জয়চণ্ডীর মন্দির নৈহাটির একটি প্রসিদ্ধ স্থান।
গঙ্গা নদীর বাঁকে যেখানে ব্রহ্মময়ীকে পাওয়া গেল, মন্দিরটি সেই জায়গায় হবে। হবে না হতেই হবে। জঙ্গলাকীর্ণ কিন্তু এর তো একজন অধিকারী থাকবেন! সেই সময়টা তো জমিদারদের কাল। জানা গেল এই অঞ্চলটি বিখ্যাত ভূস্বামী রামদেব নাগের বংশধরদের মৌজাভক্ত। বর্ধমান রাজার দেওয়ান রামদেব নাগ প্রজাপীড়নের জন্য বিখ্যাত। এই রামদেবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। তিনি বর্ধমান মহারাজকে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন। লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায় কবিতাতে। শিরোনাম নাগাস্টক। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। যথারীতি গোপীমোহন রামদেবের বংশধরদের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পেলেন না। জঙ্গলই হোক আর যাইহোক, জমি আপনাকে দেওয়া হবে না। আমাদের সম্পত্তি আমাদেরই থাকবে। বিষণ্ণ গোপীমোহন রাতে তাঁর কন্যাকে নিবেদন করলেন, মা, তুই বললি ওইখানে মন্দির করতে, ওরা যে জায়গা দিচ্ছে না। অবশেষে বহু অনুনয়, বিনয়ের পর জমি পেলেন। কী আনন্দ! চতুর্দিকে জঙ্গল। উলুখাগড়ার বন। আধুনিক দস্যু-তস্করও আছে। অজস্র সাপ। পাল পাল শেয়াল। জোয়ারের সময় চুঁইয়ে চুঁইয়ে গঙ্গার জল ঢুকে জলাভূমির মতো করে রেখেছে। ভাগীরথীতে প্রথমে দিলেন বাঁধ। দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে যেমন পোস্তা তৈরি হয়েছিল ঠিক সেইরকম। তারপর প্রচুর মাটি ফেলে ঢালাই করে তৈরি হল মন্দিরের ভিত। অর্থের অভাব নেই। দক্ষ শিল্পী, কয়েক হাজার শ্রমিক হাজির করলেন সেই জায়গায়। গড়ে উঠল অতি সুন্দর নবরত্ন মন্দির। ১৮০৯ সাল। একটি পবিত্র দিনে মন্দিরের সিংহাসনে মহাসমারোহে আরোহণ করলেন দেবীব্ৰহ্মময়ী। গোপীমোহনের আদরিণী কন্যা, মহাশক্তিরূপিণী দেবী কালিকার রূপ ধারণ করলেন। কতদিন হয়ে গেল, আজও তিনি শত শত ভক্তের পূজা। পাচ্ছেন।
এতবড় মন্দির পশ্চিমবঙ্গে খুব কমই আছে। সমতল ভিত্তির ওপর স্থাপিত এই নবরত্ন মন্দিরটি। এর দুদিকে, এপাশে-ওপাশে ছটি, ছটি করে দ্বাদশ শিবমন্দির। দক্ষিণে প্রশস্ত অঙ্গনে তিনটি দেউল। তিনজন শিব। হর, শঙ্কর ও শিব। প্রত্যেক বছর পৌষমাসে আজও বসে বিরাট মেলা। সহস্র ভক্ত নরনারী জোড়ামুলো দিয়ে মাকে পুজো করেন। এখানেই শেষ নয়। মন্দিরের পেছনে রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও আর একটি শিবদেউল। কালীমন্দিরের সামনে নাটমন্দির। তারপর বলিদানের স্থান। আর তারই নীচে গঙ্গার প্রবাহ।
২. মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে মূলাজোড়ে বসবাসের জন্য গঙ্গার তীরে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কবি, আপনার প্রতিভার পক্ষে গঙ্গাতীরবর্তী এই স্থানটি উপযুক্ত হবে। অদ্ভুত যোগাযোগ। অন্তরালে কার শক্তি! দুই রাজার সংগমে আর এক কলকাতার রাজা। বর্ধমানের মহারাজার দেওয়ান রামদেব নাগ মূলাজোড়ে জমিদারি পেলেন কীভাবে! এদিকটা তো মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারি? বর্গিরা তখন বাংলার ত্রাস। যা খুশি তাই করছে। ভয়ংকর এক আতঙ্ক। বর্ধমান তাদের টার্গেট। ওই পথেই পিল পিল করে ঢুকছে। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ তিলকচাঁদ রায়। বর্ধমান আর নিরাপদ নয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বন্ধুস্থানীয়। কাউগাছি জায়গাটি কৃষ্ণচন্দ্রের খাস জমিদারিভুক্ত। বর্ধমানরাজ সেইখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলেন।