ব্রহ্মময়ী আট বছরে পড়েছেন। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ গোপীমোহন শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করতে পারবেন না। শাস্ত্রে বলছেন, অষ্টম বর্ষে ভবেৎ গৌরী। পাত্র নির্বাচন হয়ে গেল। বিবাহের দিনক্ষণ স্থির। গোপীমোহন শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তাঁর আদরের কন্যার বিবাহ সে এক রাজকীয় ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কাজের লোকে রাজবাড়ি উৎসব মুখর। আজ ব্রহ্মময়ীর বিবাহ। পুরনারীরা জল সইতে যাচ্ছেন গঙ্গায়। কন্যাটিকেও স্নান করাবেন। সেকালের নিয়মানুসারে ব্রহ্মময়ী চলেছেন সুসজ্জিত পালকিতে আহিরিটোলার ঘাটে। পালকি জলে নামানো হল। সেকালের প্রথা অনুসারে ব্রহ্মময়ী পালকিতে বসেই স্নান করবেন। সঙ্গে এসেছেন বিশাল এক নারী বাহিনী। শঙ্খধ্বনি, উলু, অন্যান্য বাদ্যবাজনায় ভরা গঙ্গার কূলে সে এক মহা উৎসব। কারও কোনওদিকে খেয়াল নেই। প্রচুর হুড়োহুড়ি, জল ছোঁড়াছুঁড়ি। গঙ্গা আলোড়িত। হঠাৎ দেখা গেল ব্রহ্মময়ী পালকিতে নেই। সকলের অজ্ঞাতসারে জলে তলিয়ে গেছেন। তখন জোয়ার এসেছে গঙ্গায়। স্রোত চলেছে উত্তরদিকে। কোথায় ব্রহ্মময়ী! নিমেষে আনন্দ উৎসব স্তব্ধ। মুহূর্তেই সেই দুঃসংবাদ পৌঁছে গেল ঠাকুরবাড়িতে। উৎসব মুখর বাড়িতে নেমে এল শ্মশানের নীরবতা। উদ্ধারকারীর দল গঙ্গা তোলপাড় করে ফেললেন। কোথাও পাওয়া গেল না ব্রহ্মময়ীকে। দিন শেষ, রাত নামল। এল আর একটি দিন। এমন সময় খবর এল বহুদূরে মূলাজোড়ের গঙ্গার বাঁকে ব্রহ্মময়ীর প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেছে।
এই কন্যাটিই গোপীমোহনের প্রাণ ছিলেন। এক মুহূর্ত তাঁকে না দেখে থাকতে পারতেন না। কলকাতার সব মানুষই শোকস্তব্ধ। নিয়তির কী খেলা! গোপীমোহন সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন আর খোলানো যাচ্ছে না। আহার, নিদ্রা ত্যাগ। ভূমিতে শয্যা। সংকল্প করেছেন। জৈনরা যেমন করেন সেইভাবেই অন্নজল ত্যাগ করে প্রাণত্যাগ করবেন। একদিন গেল, দুদিন গেল, তিনদিনের দিন গভীর রাতে তাঁর অন্ধকার ঘরটি আলোয় বিচ্ছুরিত হল। ব্রহ্মময়ী দাঁড়িয়ে আছেন আলোর শরীর নিয়ে। অভিমান ভরে পিতাকে বলছেন, আমি তো তোমার কাছে থাকব বলেই এসেছিলাম, তুমিই আমাকে দূর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে। তাই তো আমি পালিয়ে এসেছি। আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। আমি মূলাজোড়ের গঙ্গাতীরে পাষাণ মূর্তিতে অবস্থান করছি। তুমি আমাকে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করো। আমি তোমার হয়েই থাকব।
গোপীমোহন অন্ধকারে আলোর দিশা পেলেন। তাঁকে স্বপ্ন দিয়েছেন। হঠাৎ বাঁচার উৎসাহ ফিরে এল। পরের দিনই তাঁর লোকজন নিয়ে সাত সকালেই বেরিয়ে পড়লেন মূলাজোড়ের উদ্দেশে। গঙ্গারতীরে জঙ্গলাকীর্ণ জনবসতিহীন নির্জন একটি স্থান। অনুসন্ধান করে সেইখানেই অতি অপূর্ব মূল্যবান কষ্টিপাথরে নির্মিত একটি বিগ্রহ পাওয়া গেল। বিস্ময়কর তাঁর রূপ।
মূলাজোড় স্থানটি অখ্যাত না বিখ্যাত! প্রাচীন ইতিহাস কী বলছে! বাংলার ইতিহাসে একটি অন্ধকার যুগ আছে। শুরু ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। বকতিয়ার খিলজি নদিয়া দখল করলেন। সেই থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশো উননব্বই বছরকাল বাংলার ইতিহাসের এক অন্ধকারময় যুগ, গৌড়ের সিংহাসনে হুসেন শাহের রাজত্বকাল পর্যন্ত। এই ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একটু একটু কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা বলা শক্ত। একটি সত্য পাওয়া যায় যা অস্বীকার করার উপায় নেই–সর্বস্তরে নিরবচ্ছিন্ন অকাল। লুণ্ঠন, পীড়ন, নরহত্যা, নারী নির্যাতন, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, এসব প্রতিদিনের ঘটনা। রাজশক্তি তাকিয়েও দেখত না। কারণ তাদের নিজেদের অবস্থাও শোচনীয়। সেখানে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ, গুপ্তহত্যা–সিংহাসনে নিশ্চিন্তে বসে থাকাটাই অসম্ভব। এই সময়কালের মধ্যে বাহান্ন জন রাজা গৌড়বঙ্গ শাসন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ঊনত্রিশ জন সিংহাসনে বসেছেন আর নেমেছেন। কখনও। কয়েকদিন, কখনও বড়জোর চার বছর। আঠারো জন মরেছেন গুপ্ত ঘাতকের হাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে যানজিরবিহীন। একথা মোগল সম্রাট বাবরের।
নবদ্বীপেই প্রথম আঘাত, আর এই নবদ্বীপেই প্রথম জাগরণ। ১৪৮৬ সালের ফাগুন পূর্ণিমা। আবির্ভূত হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। আলো হাতে এসে দাঁড়ালেন এক অমেয় পুরুষ সিংহ। শক্তির একটা তরঙ্গ খেলে গেল। ১৫১০ সালে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে মানুষের কল্যাণে। নিজেকে উৎসর্গ করলেন। এরপর তাঁকে আর পাওয়া গেল না। শ্রীক্ষেত্রের সাধন জগতে নিজেকে বিলীন করে দিলেন। কিন্তু রয়ে গেল যে তরঙ্গ তিনি তুলেছিলেন সর্বক্ষেত্রে তার অভিঘাত। মহাপ্রভু গৌরবঙ্গ ত্যাগ করলেন, আর মাত্র সাত বছর পরেই শুরু হল আর এক সংকটের কাল। এবার বিদেশিদের হামলা। তারা সবাই বণিক, প্রথমে পর্তুগিজ। শুরু হল তাদের অবাধ বাণিজ্য। ১৫৭০ সালে সরস্বতী নদী বেগ হারাল। সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য ও বোলবোলা শেষ হল। এইবার হুগলি। পর্তুগিজরা এখানে জমিয়ে বসতে চাইল। স্বভাবে তারা হার্মাদ জলদস্যু। স্থায়ী কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বাইরে তারা বণিক, অন্তরালে তারা দস্যু। এদের লুণ্ঠন ও উৎপীড়নে বাংলার ছোট ছোট গ্রামে দেখা দিল আতঙ্ক। জাহাজ বোঝাই নরনারী ও শিশু ইউরোপের বাজারে পাঠাতে লাগল ক্রীতদাস করে। নারীহরণ। এদের নিত্যকর্ম। প্রায় একশোটা বছর এইভাবেই কাটল। বাংলা হল শ্মশান। সেই সময় ভাগীরথীর দুই তীরে হুগলি থেকে দক্ষিণের শেষ মাথা পর্যন্ত বৃহৎ বন্দর ও বন্দরকেন্দ্রিক জনপদ ছাড়া গোটা অঞ্চলটাই ছিল জনশূন্য অরণ্য। ত্রাতা হিসাবে দেখা দিলেন মোগল। সম্রাট শাহজাহান। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ। তিনি পর্তুগিজদের নির্মূল করলেন। ১৬৫০ইংরেজ বণিকদের আবির্ভাব। আবার হুগলি, সেখানেই তাদের কুঠি স্থাপিত হল।