কলকাতায় তাঁর অনেক কাজ। দ্বারকানাথ ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উৎসাহে স্থাপিত হয়েছিল জমিদার সভা। পরে এটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন নামে শুধু পরিচিত হল না, হয়ে উঠল একটি মাইল ফলক। ১৮৫৯, ১৮৬০, এই দু-বছর দক্ষিণারঞ্জন এই অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র দক্ষিণারঞ্জনেরই প্রখর রাজনীতি জ্ঞান ছিল। রীতিমতো পড়াশোনা করতেন এই বিষয়ে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন দেশের অবস্থা বোঝার জন্যে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ভ্রমণের সময় দেশ উত্তাল হল সিপাহি বিদ্রোহের কারণে। বিদেশি ইংরেজরা ভারতবর্ষের অন্তর-চিত্রের কিছুই জানতেন না। ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, লোকাঁচার, ভাষা। এত বড় একটা দেশ। কত রকমের ভাষা, প্রথা! দক্ষিণারঞ্জন জানতেন। শাসক গোষ্ঠীর কোথায় ভুল হচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে পর পর কয়েকটি সুনিশ্চিত প্রবন্ধ লিখে শাসক মহলে আলোড়ন তুলে দিলেন। ক্যানিং-এর মতো বিচক্ষণ রাজনীতিকও বিস্মিত হলেন।
সিপাহি বিদ্রোহ অবদমিত হল। ইংরেজের পীড়ন, উৎপীড়ন, ইতিহাস হয়ে রইল। শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে কুইনের হাতে সমর্পিত হল। মহারানি ভিক্টোরিয়ার এম্পায়ার। রাজ্যের নগরে নগরে ঘোষণা। দেশের সর্বত্র মহাসমারোহে উৎসব। নট-নাট্যকার গিরিশচন্দ্র মস্ত এক কবিতা লিখলেন। সেই কবিতায় এইসব লাইন, ভিকটোরিয়া তুমি মা আমার/ ইংল্যান্ডের রাজরানি, ছিল মা ইংরাজি বাণী/ছিল মা গো ইংরাজ আকার/কিন্তু এ ভারতে জানি, ভারতের মহারানি/ভারতসন্তান সাঙ্গপাঙ্গ মা তোমার/ভিকটোরিয়া কোথা মা আমার/ বাঙালি সন্তান দীন, তুমি দীন পুত্রাধীন কালার আশ্রয় তব হৃদয় আগার/ভক্তি, পুষ্প করি দান, নহে মা এ বাক্য ভান/স্বর্গ হতে উপহার করো মা গ্রহণ/ আমি মহা ভাগ্যবান করি তোরে শ্রদ্ধা দান/হীন বাঙালির শ্রদ্ধা নাহি মা বারণ/ভিকটোরিয়া মা আবার হবে কি কখন!
ঢাকার ব্রাহ্মসমাজে বিরাট অনুষ্ঠান। বিশিষ্ট সব মানুষ সমবেত হয়েছেন। মহারানির জন্যে পরমেশ্বরের কাছে শুভাশীর্বাদ প্রার্থনা করা হবে। দক্ষিণারঞ্জন সেই সময় ঢাকাতে। তিনি আমন্ত্রিত হলেন। মনোজ্ঞ এবং দীর্ঘ ভাষণে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সুফল ব্যাখ্যা করলেন। পরমেশ্বরের কাছে ভারতবর্ষ ও ভারতশ্বেরীর মঙ্গল কামনা করলেন। ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের এই দিনের কার্যবিবরণী ও দক্ষিণারঞ্জনের বক্তৃতা একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হল।
দক্ষিণারঞ্জনের রাজভক্তি শাসক গোষ্ঠীর উচ্চ মহলে প্রশংসিত। লর্ড ক্যানিং দক্ষিণারঞ্জনের নামের সঙ্গে পরিচিত। তাঁর একান্ত পরামর্শদাতা ডাফ সাহেবের মুখে দক্ষিণারঞ্জনের প্রশংসা শুনেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের প্রবন্ধাদি ডাফ সাহেবের মাধ্যমেই তাঁর হাতে এসেছে। ডাফ শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, সূক্ষ্ম রাজনীতিও করতেন। সিপাহি যুদ্ধের ওপর একটি বইও লিখেছিলেন। ক্যানিং বিচক্ষণ শাসক। যুদ্ধের পর যুদ্ধে সমস্যার প্রকৃত সমাধান হয় না। একজন ঠান্ডা মাথার বিচক্ষণ মানুষ চাই। বিদেশি নয়, শিক্ষিত, ভারতবোদ্ধা ভারতীয়। তাঁর কাজ হবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত অভিজাতদের পোষ মানানো। ব্রিটিশ শাসনের সুফল বোঝাননা। বিনীত নাগরিকে পরিবর্তন করা। এই কাজ যিনি করবেন, তাঁর দুটো দিক থাকবে, এদিকের মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে। তাঁর কথায় আস্থা স্থাপনে দ্বিধা করবে না, আবার ইংরেজদেরও বিশ্বাসভাজন। দু-দেশের জ্ঞান থাকার প্রয়োজন। তিনি হবেন সম্রান্ত, আলোকিত, শ্রদ্ধেয় আবার সুকৌশলী। কে তিনি?ইন্দো-ব্রিটিশ, যোগসূত্রের নির্ভরযোগ্য সেতু!
ডাফ বললেন, দক্ষিণারঞ্জন। রাজভক্ত বনেদি পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। তাঁর লেখা পড়েছেন, তাঁর লেখা, তাঁর বিচক্ষণ অ্যানালিসিস আপনাকে পড়িয়েছি, আপনার মন্তব্য তাঁকে শুনিয়েছি। আধার ইন্ডিয়ান, আধেয় ইংল্যান্ড। আপাতত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালির এই অবস্থা পরের কথা পরে। দেখুন, বিখ্যাত, নট-নাট্যকার বাংলার গ্যারিক কি লিখছেন,
ভিকটোরিয়া কোথা মা আমার!
বাঙালি সন্তান দীন তুমি দীন পুত্রাধীন
কালার আশ্রয় তবু হৃদয়াগার।
এবার কেন্দ্র লখনউ। জীবনের পথে চলতে চলতে এইবার শীর্ষ। লর্ড ক্যানিংয়ের আহ্বান, চলে আসুন, অপেক্ষা করে আছে বিরাট কর্মক্ষেত্র। অযোধ্যায় শান্তি প্রতিষ্ঠা। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলেও, বিদ্রোহ পরাস্ত হয়নি। অযোধ্যার দুর্দান্ত তালুকদারদিগকে বশীভূত করিয়া রাজভক্ত প্রজায় পরিণত করিবার দুঃসাধ্য কার্য আপনাকেই করিতে হইবে। আপনি আমাদের পরম আস্থাভাজন এক রাজভক্ত।
২৫ অক্টোবর, ১৮৫৯-দক্ষিণারঞ্জনের জীবনের রেড লেটার ডে। লর্ড ক্যানিং লখনউ দরবারে ঘোষণা করলেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, আপনাকে অযোধ্যায় অবৈতনিক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের পদে অধিষ্ঠিত করা হল। এই সঙ্গে আপনাকে রায়বেরেলির অন্তর্গত শঙ্করপুর তালুকটিও প্রদান করা হল। আপাতত, আপনার কর্মক্ষেত্র অযোধ্যা প্রদেশ।
শঙ্করপুরের তালুকটি ছিল রাজা বেণীমাধো বক্সের। তিনি সিপাহি আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। সরকার তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এই তালুকটির সেই সময় বাৎসরিক আয় ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। তালুকটি যথেষ্ট বড়। জায়গায়, জায়গায় ভীষণ অরণ্য। হিংস্র পশু শুধু নয়, হিংস্র মানুষের বাস। দক্ষিণারঞ্জনের অক্লান্ত চেষ্টা ও ব্যবস্থাপনায় অঞ্চলটি উন্নত হল। জীবনের শেষ আকাশে সূর্যোদয় ঘটালেন ডফ সাহেব। এই সাহেবকে কী ভাবে তাঁর হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাবেন! তাঁর তালুকের একটি গ্রামের নাম রাখলেন, ডফপুর। তাঁর নামে ভারতের একটি গ্রাম চিহ্নিত হতে চলেছে শুনে সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে একটি আবেগভরা চিঠি লিখেছিলেন, তারই একটি অংশ: