বেথুন স্কুল, বেথুন কলেজ কত বড় ইতিহাস এই কলকাতার বুকে! ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিশিষ্ট কয়েকজন সাহেব–স্যার জন লিটলার, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, লর্ড বিশপ, স্যার এফ ক্যারি, মিস্টার লাউইস, স্যার আর্থার বুলার, স্যার জেমস কলভিল, ফ্রেডারিক হ্যাঁলিডে, স্যার জন রাসেল, স্যার জন পিটার, ডাক্তার মৌয়েট, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জনের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে সান্ধ্য ভোজনে মিলিত হয়েছিলেন। কজনই বা মনে রেখেছে এই ইতিহাস! মহান বেথুন সাহেব মৃত্যুকালে এই বিদ্যালয়ের জন্য নগদ তিরিশ হাজার টাকা ও তাঁর অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি দান করে যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তাঁর মৃত্যর পর লেডি ডালহৌসি বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য মাসে ছশো টাকা অর্থ সাহায্য করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর লর্ড ডালহৌসি এই সাহায্য বজায় রেখেছিলেন। তারপরেই কোম্পানি বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দক্ষিণারঞ্জনের তৃতীয় জীবন শুরু হয়েছে। প্রথম জীবনে অ্যাংরি ইয়ংম্যান, দ্বিতীয় জীবনে কর্মব্যস্ত আইনজীবী ও রানি বসন্তকুমারীর সঙ্গে চিরকালের গাঁটছড়া বাঁধা। তৃতীয় জীবনে চরম পরিণতি। কলকাতার কালেকটারি ছাড়তে হল। এই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ত্রিপুরায় গেলেন রাজসচিব হয়ে। এসব ১৮৫১ সালের কথা। ত্রিপুরাও ভালো লাগল না। কয়েকমাস পরে এলেন মুর্শিদাবাদে। তখন নবাব নাজিম ফরেদুনজা। দক্ষিণারঞ্জন দেওয়ান হলেন। এই সময়ে তিনি রাজ উপাধিতে ভূষিত হলেন। শুধু রাজা নয়। আর একটি নবাবি উপাধি পেলেন, মাদার-উল-মাহাম, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। মুর্শিদাবাদের এই উচ্চ পদে তিনি যথেষ্ট সুখ্যাতি পেলেন। এই পদে থাকাকালীন গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট মিস্টার হেনরি টরেন্সের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হল। সাহেব তাঁকে ভীষণ ভালোবেসে ফেললেন। টরেন্স সেকালের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। সুদক্ষ রাজকর্মচারী, আবার একজন প্রকৃত পণ্ডিত ও সাহিত্যসেবী। সেই কারণেই ডিরোজিয়ান দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর এত ভাব-ভালোবাসা। টরেন্স তিনটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-Calcutta Star, Eastern Star, Meerut Observer | অনুবাদক ও মৌলিক গ্রন্থপ্রণেতা। সাহিত্যের এইসব বিভাগ তাঁর প্রতিভা স্বীকৃত। সাত বছর এশিয়াটি সোসাইটির সভাপতি ও তিন বছর সহকারী। সভাপতি ছিলেন। এমন একজন বিদগ্ধ মানুষ দক্ষিণারঞ্জনের প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য। সেই সময় শাসন ক্ষেত্রে গুণী, আলোকিত মানুষ কোথায়!
নবাব ফরেদুনও দক্ষিণারঞ্জনকে খুব ভালো চোখে দেখতেন। তিনি সেই সময় বয়সে তরুণ। দক্ষিণারঞ্জন অত্যন্ত সৎ, রাজকার্যে অত্যন্ত পারদর্শী। তরুণ ফরেদুনের ইয়ার বন্ধুরা সুবিধের ছিলেন না। নবাবকে গোল্লায় পাঠাবার সব রাস্তাই এদের জানা। যেমন সিরাজের পতনের কারণ তাঁর অসভ্য সঙ্গীরা। টরেন্সের কালে ইংরেজ সরকার হঠাৎ নবাব সরকার থেকে যে বৃত্তি পেতেন, তা কমিয়ে দিলেন। আর নিজামত তহবিলেও ভাগ বসালেন। এই ইস্যুতে নবাবের সঙ্গে টরেন্সের লড়াই শুরু হল। মিটমাটের জন্য দেওয়ান দক্ষিণারঞ্জন প্রচুর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। হেনরি টরেন্স গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করার জন্যে কলকাতায় এসে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। সাল, ১৮২৫, ১৬ আগস্ট। সন্দেহজনক মৃত্যু। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর এক প্রিয় বন্ধুকে হারালেন। বিরাট আঘাত।
টরেন্সের বিতর্কিত মৃত্যুর পর নবাব ফরেদুন তাঁর কুমন্ত্রীদের পরামর্শে লর্ড ডালহাউসির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। ঘটনাটি এইরকমনবাবের কিছু জহরত চুরি হল। রাজকর্মচারীরা কয়েক জনকে ধরে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলল। নবাবের প্রধান খোজা আমান আলিখাঁ ও আরও কয়েকজনকে ধরে এনে সুপ্রিম কোর্টে তোলা হল। প্রমাণের অভাবে তাঁরা ছাড়া পেলেও নবাবের কাছে সরকারি নির্দেশ এল, এদের যেন পুনর্বহাল করা না হয়। ফরেদুন এই আদেশ উপেক্ষা করলেন। সরকার সঙ্গে সঙ্গে নবাবের অনেক ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। সম্মানসূচক ১৯ বার তোপধ্বনি কমে হল ১৩ বার। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদের নিজামত দক্ষিণারঞ্জনের পক্ষে আর নিরাপদ রইল না। ফিরে এলেন কলকাতায়।
মানুষের জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। ওঠা-পড়া। সামান্য সময়ের জন্য থমকে যাওয়া। এই সময় কয়েকটি বড় বড় মৃত্যু। প্রথমে বঙ্গবন্ধু বেথুন সাহেবের মৃত্যু। একদিকের আকাশ নক্ষত্রশূন্য। এরপরেই চিরবিদায় নিলেন প্রিয় বাল্যবন্ধু জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক সুধী, বাগ্মী, সুলেখক রসিককৃষ্ণ মল্লিক। দক্ষিণারঞ্জন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্ধুর শয্যাপার্শ্বে ছিলেন। খুব সেবা করেছিলেন। রসিককৃষ্ণ ছিলেন তাঁর হৃদয়ের হৃদয়। তাঁকে অদেয় কিছু ছিল না। একবার দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে আহারাদির পর একটি বহু মূল্য সুন্দর সোনার তাম্বুল দান থেকে তাঁকে পান দেওয়া হচ্ছিল। রসিককৃষ্ণ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে দেখতে বললেন–ওঃ কী সুন্দর! দক্ষিণারঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে সেই বহু মূল্য বস্তুটি বন্ধুকে উপহার দিলেন। এইরকম বড় মনের মানুষ ছিলেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন। ক্রমশই বড় একা হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে শরীর বিদ্রোহ করছে। অজ্ঞাত এক অসুখ–প্রবল শিরঃপীড়া।