দক্ষিণারঞ্জন সরকারের অধীনে কলকাতার কালেক্টর হলেন। এই পদে সেকালে কোনও দেশীয় মানুষকে নিযুক্ত করা হত না। প্রবীণারা বলবেন, দেখেছ! বিয়ের পরেই ভাগ্য খুলে গেল! আবার যে-সে বিবাহ নয়, এক রাজার সঙ্গে এক রানির। রোমান্টিক, বিপদে ভরা। দক্ষিণারঞ্জনের প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বৃদ্ধ রাজা তেজচাঁদ পরলোকে। অনেক বিধবা স্ত্রী রেখে গেছেন। বসন্তকুমারী তাঁদের একজন, সর্বকনিষ্ঠা। তাঁর পিতা পরাণচাঁদ সেই সময় জাল প্রতাপচাঁদকে নিয়ে জেরবার। বসন্তকুমারীর গতিবিধি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। লাভবান হলেন দক্ষিণারঞ্জন। জীবনসঙ্গিনীর প্রয়োজন ছিল। তিনি আবার ক্ষত্রিয় রাজকুমারী। অনেকটা রূপকথার গল্প।
কলকাতায় তখন স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে বাঙালি সমাজপিতা ও ইউরোপিয় সংস্কারকরা খুব উদ্যোগী হয়েছেন। ইউরোপিয় রেনেসাঁর প্রভাব। পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের, স্ত্রী, পুরুষ, নির্বিশেষে জাগরণ চান। মুক্তি চান। শিক্ষার বিস্তার চান। মধ্যযুগ থেকে নতুন যুগে বের করে আনতে চান–A new world। বড় চমৎকার একটা পৃথিবীর স্বপ্ন। এদেশের ইংরেজ শাসকরা নারীমুক্তি, স্ত্রী শিক্ষার কথা তখনও ভাবেননি। প্রথম ভাবনা এসেছিল পাদরিদের মনে। ১৮২১ সালে স্কুল সোসাইটির কয়েকজন সভ্য এই ব্যাপারে অগ্রণী হলেন। ইংল্যান্ড থেকে এক শিক্ষিতা মহিলাকে এদেশে আনলেন, তাঁর নাম কুমারী কুক। স্কুল সোসাইটি যেসব বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, সেগুলি পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন একটি বিদ্যালয়ে একজন ছাত্রের সঙ্গে তাঁর ছোট বোনও এসেছে। সে স্কুলে প্রবেশের অনুমতি চাইছে কাতর কণ্ঠে। কিন্তু গুরুমশাই কিছুতেই তাকে স্কুলে ঢুকতে দিলেন না। মিস কুক সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। সেই কাল, অজানা এক বালিকা, আর একা বিদেশিনি, এই তিনের সমন্বয়ে সময়। কীরকম ঘুরে গেল। একটা অন্ধযুগের অবসান ঘটতে চলেছে। রেনেসাঁর সূত্রপাত। শ্রীমতী কুকের চেষ্টায় এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আটটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হল। কুমারী কুক রেভারেন্ড আইজ্যাক উইলসনকে বিবাহ করলেন। কিন্তু জীবনের ব্রত পরিত্যাগ। করলেন না। বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। স্থির করলেন যেভাবেই হোক উত্তর কলকাতার কেন্দ্র স্থলে বড় আকারের একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। করতে হবে। চাই একটি গৃহ। ১৮২৪ সালে শ্রীমতী কুক কয়েকজন সম্রান্ত ইংরেজ মহিলাকে নিয়ে একটি মহিলা সমিতি স্থাপন করলেন–Bengal Ladies Society। সমিতির অধিনেত্রী হলেন লেডি অ্যামহার্স্ট। ১৮২৬ সালের ৮ মে সিমুলিয়ায় মহা সমারোহে স্কুলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল। ঠিক দু-বছর পরে ১৮২৮ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে মিসেস উইলসনের স্কুল শুরু হয়ে গেল। হিন্দুদের মধ্যেও উৎসাহ জাগল, যেন ঘুম ভাঙল।
রাজা বৈদ্যনাথ রায়বাহাদুর শ্রীমতী কুকের স্কুল বাড়ি নির্মাণের জন্য কুড়ি হাজার টাকা দান করেছিলেন। ওদিকে রাজা স্যার রাধাকান্তদেব বাহাদুর একটি প্রস্তাব প্রকাশ করেছিলেন–স্ত্রী শিক্ষা বিধায়ক প্রস্তাব। এবার তিনি নিজেই নিজের বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। এই আন্দোলনে এইবার যিনি এলেন–তিনি বিখ্যাত ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। আমাদের ইতিহাসে এই বিদেশি, মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত। তিনি এসেই লক্ষ্য করলেন, সম্রান্ত পরিবারের মেয়েরা স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী হলেও সরকারের কোনও আগ্রহ নেই। বেথুন সাহেব নিজের অর্থে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সম্রান্ত হিন্দুদের আহ্বান জানালেন এই ব্রতে ব্রতী হওয়ার জন্য। প্রথমেই এগিয়ে এলেন দক্ষিণারঞ্জন। প্রতিদিন স্কুল চালানোর জন্য বেথুন সাহেবের অনেক খরচ। রাজা রাধাকান্তদেব, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জাস্টিস শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা কালীকৃষ্ণ। দেবও বেথুন সাহেবকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। সম্রান্ত পরিবার থেকে ছাত্রীরাও এলেন বেথুন সাহেবের স্কুলে পড়ার জন্য। এখন চাই একটি নিজস্ব বিদ্যালয় গুহ। এই স্কুলে বেথুন সাহেব প্রতিমাসে প্রায় আটশো টাকা খরচ করতেন। তিনি বিদেশি, অনেক কষ্টে অর্থ। উপার্জন করেন। এরপরে খরচ যখন আরও বাড়বে তখন কী হবে! দক্ষিণারঞ্জন নিশ্চেষ্টভাবে বসে থাকতে পারলেন না। তাঁর জাতিরও তো একটা সম্মান আছে। স্যার বেথুনের সঙ্গে। সাক্ষাৎ করে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণের জন্য বারো হাজার টাকা মূল্যের বিরাট একটি জায়গা দান করলেন। বেথুন তখনও দক্ষিণারঞ্জনকে চেনেন না। অপরিচিত ব্যক্তির অযাচিত দানে। তিনি বিস্মিত। এই জমির ওপর ১৮৫০ সালের ৬ নভেম্বর বাংলার তদানীন্তন ডেপুটি গভর্নর স্যার জন লিটলার বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করলেন। সেদিনের বক্তৃতার একটি জায়গায় তিনি বললেন, Dakhina Runjun Mookerjee was an utter stranger to me. I had never before heard his name, when he introduced himself to me, a year and a half ago, for the purpose of letting me know that he heard of my intention of founding a Female School for the benefit of his Country, that he could not bear the thought that if should be said here after of his countrymen that they all stood idly looking on without offering any help in furtherance of the good work and in short, without further perface that he was the propritor of a picee of ground in Calcutta, Valued as I have since learned, at about twelve thousand Rupees, which he placed freely and unconditionally at my disposal for the use of the school. It was noble gift, and nobly given… It is due to Dakhina Runjun Mookerjee, that his name should be held in perpetual remembrance in connexion with the foundation of this school.