মহারানি বসন্তকুমারী দক্ষিণারঞ্জনের মধ্যে এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন। রাজপরিবারে যাঁদের তিনি দেখেছিলেন তাঁরা কেউই যথেষ্ট শিক্ষিত ও উদার মানুষ ছিলেন না। বিষয়ই ছিল তাঁদের বিষয়। জমিদারি, খাজনা, লাঠালাঠি, মামলা-মোকদ্দমা এবং ভোগ। ইন্দ্রিয় বুদ্ধি প্রবল। সমাজ সংস্কার, দিঘি খনন, ফুলবাগান তৈরি, মন্দির প্রতিষ্ঠা–এইসব হল সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের উপায়। ইংরেজ তত তাদের শাসন ক্ষমতায় স্থান দেবে না। তাই এইভাবে নিজেদের জন্য সম্মানের ব্যবস্থা করা। রাজপরিবারে পুরুষের চেয়ে নানা বয়সের মহিলার সংখ্যাই বেশি। বসন্তকুমারীর পিতা একেবারেই সুবিধের মানুষ ছিলেন না। জাল প্রতাপচাঁদ মামলার সূত্র ধরে তাঁর বদনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বসন্তকুমারী এক ক্যাপটিভ লেডি। অতি অসহায়। বালিকা থেকে যখন যুবতী হলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে ভালোবাসা এল। দীর্ঘদেহী সুস্থ, সুন্দর এক রমণী। তিনি ভালোবাসতে চান এমন কোনও মানুষকে যাঁর মধ্যে প্রেম আছে, দায়িত্ববোধ আছে। শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান, উচ্চবংশীয়। কারণ তাঁর মধ্যে আভিজাত্য ছিল। দক্ষিণারঞ্জন ঈশ্বরপ্রেরিত, ডিরোজিওর প্রিয় ছাত্র। ধর্মবিশ্বাসী, উদার। সমাজসংস্কারক, শিক্ষার প্রসার বিশেষত স্ত্রী শিক্ষা ও স্বাধীনতার যাজ্ঞিক। বসন্তকুমারী যেন একটি দুর্গের আশ্রয় পেলেন। এখন প্রয়োজন রাজকারাগার থেকে মুক্তি। তিনি হয়তো পলাতকা, কিন্তু এমন নয় যে দক্ষিণারঞ্জন মধ্যযুগীয় কোনও ডন। জুয়ানের মতো তাঁকে অপহরণ করতে চেয়েছিলেন। বসন্তকুমারী একবারও বলেননি, আমি তোমাকে ভালোবাসছি বলেই রাতের অন্ধকারে পালাতে চাইছি। তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল। চক্রান্তকারীদের হাত থেকে নিজের যোগ্য প্রাপ্যটুকু বুঝে নেওয়া। প্রথমবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় ফিরে গেলেন, এই আশ্বাস দিয়ে মামলা করব এবং তোমার প্রাপ্য আদায় করে দেব। এই তুমি কোনও সাধারণ মক্কেল নয়। সুন্দরী, স্বাধীনচেতা এক রমণী। বসন্তকুমারী যেমন এক নায়ককে দেখলেন, নায়কও দেখলেন এক সুযোগ্য নায়িকাকে। কর্মতৎপর এক মানুষ। সারা ভারত তাঁর কর্মক্ষেত্র। সুবক্তা, সুলেখক, সর্বোপরি সমাজদরদি এক মানুষ।
দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় ফিরেই একটি মামলা দায়ের করলেন মহারানির হয়ে। সদর আদালত থেকে একটি আদেশনামা বের করলেন। যাতে বসন্তকুমারী বিনা বাধায় কলকাতায় এসে তাঁর মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এই আদেশবলে বসন্তকুমারী রাজপরিবারের সমস্তরকমের অসভ্যতা পাশ কাটিয়ে কোনওরকম বাধা ছাড়াই কলকাতায় এলেন। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর উঁকিল। বসন্তকুমারী তাঁর ক্লায়েন্ট। দক্ষিণারঞ্জনের সহানুভূতি ও সমবেদনা, মহারানির গভীর বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা। দুটি নদীর দুটি ধারা মিলিত হয়ে তৈরি হল একটি সংগম। কোনওরকম দেরি না করে তাঁরা এই আলগা সম্পর্ককে একটি স্থায়ী মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন। সিদ্ধান্তটি সেকালের প্রেক্ষিতে ভয়ঙ্কর রকমের সাহসী এক ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে আহ্বান করে হিন্দুমতে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। দক্ষিণারঞ্জন আইন জানতেন, নিজের সমাজকে চিনতেন। এই অনুষ্ঠান যে যথেষ্ঠ আইনসিদ্ধ নয় তাও তিনি জানতেন। কারণ হিন্দু সমাজে অসবর্ণ বিধবাবিবাহ অসিদ্ধ। দক্ষিণারঞ্জন কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্চকে সাক্ষী রেখে সিভিল ম্যারেজ করলেন। অর্থাৎ রেজিস্ট্রি হল। এই বিবাহ সম্পর্কে স্বয়ং রাজনারায়ণ বসু লিখছেন, দক্ষিণারঞ্জন বলিতেন যে, তিনি যেমন ধর্মসংস্কারক তেমনি সমাজসংস্কারক। রানি বসন্তকুমারীকে বর্ধমান হইতে কলিকাতায় আনিয়া কলিকাতার পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট বার্চ সাহেবের সম্মুখে Civil Marriage নামক বিবাহ করেন। ভাস্কর সম্পাদক গুড়গুড়ে পণ্ডিত তাহার সাক্ষী থাকেন। গুড়গুড়ে পরিতের প্রকৃত নাম গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। লক্ষ্ণৌ অবস্থিতিকালে তিনি (দক্ষিণাবাবু) একদিন আমাকে বলিলেন যে তিনি বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ ও সিভিল বিবাহ এককালে করিয়াছেন। তাঁহার ন্যায় সমাজসংস্কারক আর কে আছে? দক্ষিণারঞ্জন ব্রাহ্মণের সহিত ক্ষত্রিয় কন্যার বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সম্পূর্ণরূপে হিন্দুশাস্ত্রানুমোদিত জ্ঞান করিতেন। আমি যখন লক্ষৌ-এ ছিলাম তাঁহার পূর্বে তাঁহার পুত্রবিয়োগ হইয়াছিল, কেবল পৌত্র বিদ্যমান ছিল। তিনি উইল না করিলেও এই পৌত্রের বিষয় পাওয়ার প্রতি তাঁহার কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
গুড়গুড়ে পণ্ডিত, ডাঃ ডি গুপ্ত এবং দক্ষিণারঞ্জনের আরও কয়েকজন বন্ধুর স্বাক্ষরযুক্ত বিবাহ সম্বন্ধীয় দলিলটি মহারানি বসন্তকুমারী তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। মহারানি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের কোনও একসময়ে পরলোকগমন করেন। দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার লিখছেন, রাজনারায়ণ বসুর মতো মানুষ যখন এই কথা লিখছেন তখন ওই কটা সাহেবের কুৎসাপূর্ণ বর্ণনার যে-কোনও ভিত্তি নেই, শুধুমাত্র চরিত্র হননের উদ্দেশ্যেই করা তা সাব্যস্ত হল। দুজনেই বড় সুখে দিন কাটিয়েছিলেন একথা ভাবতেও ভালো লাগে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা দরকার, বিবাহের পর আদালতে রানির মোকদ্দমাটিও আপসে নিষ্পত্তি হল। কলকাতার কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি যেমন মতিলাল শীল, রমাপ্রসাদ রায় এবং আরও কয়েকজন মধ্যস্থতা করে দুটি ব্যবস্থা আদায় করে দিলেন–দক্ষিণারঞ্জনের বিবাহিত স্ত্রী মহারানি বসন্তকুমারী তাঁর সঙ্গে বাস করবেন। আর মহারানি তাঁর বিষয়ের উপস্বত্ব স্বরূপ বর্ধমান রাজকোষ থেকে আজীবন পাঁচশত টাকা মাসিক বৃত্তি পাবেন। বসন্তকুমারী মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই মাসোহারা পেয়েছিলেন।
৬. দক্ষিণারঞ্জনের দ্বিতীয় বিবাহ
বিবাহ হয়ে গেল দক্ষিণারঞ্জনের দ্বিতীয় বিবাহ, বসন্তকুমারীরও দ্বিতীয় বিবাহ, ৪৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে দুজনে সংসার শুরু করলেন। একেই বোধহয় বলে শুভ বিবাহ।