ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরির ভূতপূর্ব সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজও এডওয়ার্ডসের বই অবলম্বন করে লিখলেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় যখন দেওয়ান ছিলেন সেইসময় যুবতী বিধবা রানির অনুগ্রহভাজন হন এবং অবশেষে তাঁহাকে লইয়া পলায়ন করেন। রাজবাটি হইতে প্রেরিত কয়েকজন অশ্বারোহী পলাতক দম্পতির পশ্চাদ্ধাবন করে এবং পথিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জনকে গ্রেপ্তার করিয়া গুরু প্রহারে জর্জরিত করিতে আরম্ভ করে, তাহারা বোধহয় তাঁহাকে হত্যা করিত কিন্তু ঘটনাক্রমে এইসময় তিনজন ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারক ডাকগাড়িতে কলিকাতা হইতে অন্যত্র যাইতে ছিলেন, ইঁহারা ভয় প্রদর্শন করাতে অশ্বারোহীরা দক্ষিণারঞ্জনকে ছাড়িয়ে দেয় এবং রানিকে লইয়া রাজবাড়িতে প্রত্যাবৃত্ত হয়। কিন্তু অনতিকাল পরে কোনও মোকদ্দমার জন্য রানি কলিকাতায় আগমন করেন এবং দক্ষিণারঞ্জনের সহিত মিলিত হন। যেরূপ প্যারিনগরে নেপোলিয়ান পোপ সপ্তম পায়াসকে তাঁহার অভিষেকক্রিয়া করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন সেইরূপ হিন্দু আচারানুসারে বিধবা রানির বিবাহ অসম্ভব হইলেও দক্ষিণারঞ্জন তাঁহার এক বেতনভোগী ব্রাহ্মণের দ্বারা রানির সহিত বিবাহিত হইয়াছিলেন।
দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ এই দুটি বিবরণই অস্বীকার করেছেন। প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত করা হয়েছে। এডওয়ার্ডস লোকটি বিশেষ সুবিধের ছিলেন না। তিনি যত বড় ঐতিহাসিক তার চেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী। যে-কোনও প্রতিষ্ঠিত মানুষ সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে বাজার গরম করতে ভালোবাসতেন। দক্ষিণারঞ্জন যখন লখনউতে ছিলেন তখন এই এডওয়ার্ডস তাঁর এবং অন্য আর একজন কমিশনারের নামে যাচ্ছেতাই অপপ্রচার করেছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন তখন এডওয়ার্ডসকে তিরস্কার করে উপযুক্ত শাস্তি পাইয়ে লখনউ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। সেই রাগ তিনি এই সুযোগে উগরে দিলেন। দ্বিতীয় কথা, কোন ভিত্তিতে তিনি দক্ষিণারঞ্জন সম্পর্কে যা তা লিখলেন তার কোনও উল্লেখ করতে পারেননি। একটি কথাতেই সেরে দিয়েছেন–জনশ্রুতি। বাঙালির স্বভাবই হল পরনিন্দা। যে-কোনও সামান্য ঘটনাকে পল্লবিত করে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেয় যখন তা আর প্রকৃত ইতিহাস না। হয়ে সুস্বাদু উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এডওয়ার্ডসের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায়, পুরোটাই তাঁর ইচ্ছাকল্পিত। দক্ষিণারঞ্জন যে কত বড় মানুষ, কত ভালো ভালো কাজ করেছেন তার কোনও উল্লেখ নেই। রানি বসন্তকুমারীর সঙ্গে তাঁর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন একজন লম্পট এমন কথা তো ইতিহাস স্বীকার করবে না। একের পর এক মিথ্যা কথা বলেছেন। প্রথম, দক্ষিণারঞ্জন কখনও বর্ধমান রাজের দেওয়ান ছিলেন না। এডওয়ার্ডসের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি লিখছেন, মহারানি বসন্তকুমারীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি ও দক্ষিণারঞ্জন স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় বাস করিতেন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডস খবরই রাখতেন না, কে আগে মারা গেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের মৃত্যুর পর রানি বসন্তকুমারী ১৫/১৬ বছর জীবিত ছিলেন। সেই সময় দক্ষিণারঞ্জনের সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। দক্ষিণারঞ্জনের একজন বাল্যবন্ধুই তাঁর সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। তিনি কে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই আচার্য কৃষ্ণমোহন। বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণারঞ্জন অল্পবয়সেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে তাঁর বিখ্যাত সতীর্থদের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না। ডেভিড হেয়ার, ডিরোজিও ও ডক্টর ডফ তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কৃষ্ণমোহনের এইটাই হয়েছিল গাত্রদাহ। এডওয়ার্ডস তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় যে স্বীকারোক্তি করেছেন সেইটিই তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি লিখছেন, I have to acknowledge with many thanks, the very kind manner in which I have been aided in this bit of work by the revd Krishna Mohun Banerjea, L.L. D. & C. & C.93 স্বীকারোক্তিটি দেখে দক্ষিণারঞ্জনের প্রকৃত বন্ধুরা বুঝতেই পেরেছিলেন কৃষ্ণমোহন পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি হলেও অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন তাঁর বিপদের বন্ধু ও আশ্রয়দাতা। সে কথা তিনি মনে রাখেননি। এর পরেও এডওয়ার্ডসের আর একটি উক্তি। তিনি লিখেছেন, দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই রানির চরিত্র লন হয়েছিল। অসাধারণ সিদ্ধান্ত। রাজ অন্তঃপুরের অসূর্যম্পশ্যা। তিনি ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডদের কৃপায় চরিত্রহীনা হলেন। ইচ্ছে। করলে মহারানি মানহানির মামলাও করতে পারতেন। কিন্তু উপায় ছিল না।
জীবনীকার মন্মথবাবু সমস্ত অনুসন্ধান করে প্রকৃত যা ঘটেছিল তার একটি বিবরণ রেখে। গেছেন। দক্ষিণারঞ্জন কখনও বর্ধমান রাজের দেওয়ান ছিলেন না। বসন্ত পঞ্চমীতে বর্ধমানে তখন মহাউৎসব হইত এবং এখনও হইয়া থাকে। এইরূপ এক উৎসবে নিমন্ত্রিত হইয়া দক্ষিণারঞ্জন বর্ধমানে গমন করেন এবং কিছুকাল তথায় অবস্থিতি করেন। এরপরে যা লিখছেন তা সঞ্জীবচন্দ্রের লেখারই উদ্ধৃতি। পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। পরবর্তী অংশটি উল্লেখ করতেই হয় প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। এখানেও বিশেষ কয়েকটি দিক পরপর তুলে। ধরলেই হবে। যেমন–১) তেজচন্দ্রবসন্তকুমারীর নামে কিছু সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিষয়ের উপস্বত্ব তিনি ভোগ করতে পাননি। ২) মহারানি কমলকুমারী তখন রাজপরিবারের সর্বময়ী কত্রী। ৩) তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কুচক্রী ভ্রাতা। ৪) দক্ষিণারঞ্জন। সদর আদালতের উঁকিল। তিনি রাজ অতিথি। ৫) মহারানি বসন্তকুমারী গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। উদ্দেশ্য বিষয়ের অধিকার অর্জনের উপায় বের করা। ৬) স্থির হল মহারানি বসন্তকুমারী কলকাতায় যাবেন, বিষয়ের জন্য সদর আদালতে আবেদন করবেন। ৭) বসন্তকুমারী জানতেন, কমলকুমারীর অনুমতি নিয়ে বর্ধমান ত্যাগ করা সম্ভব নয়। ৮) দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হল বসন্তকুমারী গোপনে দুজন বিশ্বস্ত দাসী ও একজন পুরুষ আত্মীয়কে নিয়ে বর্ধমান ত্যাগ করবেন। দক্ষিণারঞ্জনও মহারানির অনুগমন করবেন।