কিন্তু তাঁর কথাবার্তা ও চালচলনে পাগলামির কোনও চিহ্ন ছিল না। বরং অসাধারণ বুদ্ধিমান ও সর্বশাস্ত্রজ্ঞ এক ব্যক্তি। বিলেতের রাজনীতিতে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান। সমস্ত দেশের ইতিহাস তাঁর নখাগ্রে। সবচেয়ে ভালো বুঝতেন রুশ পলিটিক্স। বেদান্ত শাস্ত্রেও মহাপণ্ডিত।
এইটা তাঁর একটা দিক। আর অন্যদিকে বিচিত্র তাঁর পাগলামি। কখনও তিনি নিজেকে শালগ্রাম শিলা মনে করতেন। সর্বদা বসে থাকতেন ঝারায়। লোকের সচন্দন পুস্পাঞ্জলি নিতেন। পূজা গ্রহণ করতেন, বৈকালিও খেতেন। অনুগামীদের মধ্যে স্ত্রীলোকের সংখ্যা বেশি হলেও পুরুষের সংখ্যাও কম ছিল না। বাবাজিরা এসে তাঁর দরজায় পড়ে থাকতেন। স্ত্রীলোকদের ধারণা হয়েছিল এই মানুষটি সাক্ষাৎ দেবতা। তিনি যে মন্ত্র দিতেন তা বিষ্ণু। মন্ত্রও নয়, শক্তি মন্ত্রও নয়। তাঁর দীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ও অর্চনা করার পদ্ধতি একদম ভিন্ন। এই নতুন ধর্মটি পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়াল তঙ্কালের বিখ্যাত ঘোষপাড়ার দল অর্থাৎ কর্তাভজা সম্প্রদায়। এখন এই লেখক যেখানে বসবাস করেন তাঁর দূরেই ময়রাডাঙার একটি বাড়িতে ১৮৫২ অথবা ৫৩ সালে এই সাধুর জীবনাবসান হয়। সেই সময় তিনি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। সঞ্জীবচন্দ্র লিখছেন, তাঁহার যাত্রার সময় চক্ষের জল মুছিবার কেহ ছিল না।
৫. এইবার কাহিনি মুখ ফেরাবে কলকাতার দিকে
এইবার কাহিনি মুখ ফেরাবে কলকাতার দিকে। বর্ধমানে মঞ্চ প্রস্তুত। আবির্ভূত হবেন দক্ষিণারঞ্জন। তিনি এখনও রাজা হননি। কলকাতার উচ্চ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেছেন। আগেই বলা হয়েছে ছাত্র অবস্থায় তাঁর বিবাহ হয়েছিল হরচন্দ্র ঠাকুরের সুন্দরী কন্যা জ্ঞানদাসুন্দরীর সঙ্গে। তাঁর একটি মাত্র কন্যাসন্তান মুক্তকেশী। এই মেয়েটি হওয়ার পরই জ্ঞানদাসুন্দরীর মাথা খারাপ হয়ে গেল। দক্ষিণারঞ্জনের দাম্পত্য জীবন খুবই দুঃখের। ওদিকে বর্ধমানে আর একটি মেয়ের জীবনও তথৈবচ। তাঁর নাম মহারানি বসন্তকুমারী। পিতা পরাণবাবুর লোভের বলি। বৃদ্ধ রাজার কাছে মেয়েটিকে সমর্পণ করে ছেলের ভবিষ্যৎ তৈরি করলেন। যুবতী বসন্তকুমারীর কী হল তা দেখার দরকার নেই। বৃদ্ধ রাজা প্রয়াত, বসন্তকুমারীর জীবনে কিছুই জুটল না। বর্ধমানে বসন্তপঞ্চমীতে সেইসময় বিরাট উৎসব হত। এখনও হয়। বহু বড় বড় মানুষ নিমন্ত্রিত হতেন। একটি উৎসবে দক্ষিণারঞ্জনও নিমন্ত্রিত হলেন। তিনি সাদরে সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে কিছুদিনের জন্য বর্ধমানে গেলেন। মহাতাব চাঁদ তখনও সাবালক হননি। রাজকার্য চালাচ্ছেন কমলকুমারী আর তাঁর কুখ্যাত ভ্রাতা পরাণবাবু। বলা যায় পরাণবাবুই রাজা। দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ লিখছেন, মহারানি বসন্তকুমারী বিষয়ী পিতার স্বার্থসিদ্ধির জন্য নামে দুইদিনের জন্য মহারানি হইলেন বটে কিন্তু তাঁহার ন্যায় দুঃখিনী আর কে ছিল। আইনজ্ঞ দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম। বসন্তকুমারী অতি সুন্দরী। দক্ষিণারঞ্জনও কিছু কম যান না। জীবনীকার লিখছেন, তেজচন্দ্র বসন্তকুমারীর নামে কিছু সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সেই বিষয়ের উপস্বত্বও তিনি ভোগ করিতে পাইতেন না। দক্ষিণারঞ্জনকে সদর আদালতের উঁকিল জানিয়া মহারানি বসন্তকুমারী তাঁহার সহিত গোপনে বিষয় উদ্ধারের পরামর্শ করিলেন। স্থির হইল, মহারানি বসন্তকুমারী কলিকাতায় আগমন করিয়া বিষয়ের জন্য সদর আদালতে আবেদন করিবেন। মহারানি কমলকুমারী তখন বর্ধমানের সর্বময়ী কত্রী। তিনি বসন্তকুমারীর সঙ্কল্পের কথা জানিতে পারিলে অনর্থ ঘটিবে এইজন্য মহারানী বসন্তকুমারী গোপনে দুইজন বিশ্বস্তা দাসী ও একজন পুরুষ আত্মীয় সমভিব্যাহারে বর্ধমান পরিত্যাগ করিলেন।
দক্ষিণারঞ্জনের শত্রুর অভাব ছিল না। এবং তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন টমাস এডওয়ার্ডস। তিনি ডিরোজিওর জীবনী লিখেছিলেন। বসন্তকুমারী ও দক্ষিণারঞ্জনের মধ্যে গভীর একটি প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এই উৎসবের রাতেই। দুজনের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কে আলোচনাও হয়েছিল। সেই রাতের পর ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ হওয়াও স্বাভাবিক। আর লোকমুখে সেটি পল্লবিত হয়েছিল। রাজবাড়ির মুচমুচে কুৎসা হিসেবে, ছোটরানির প্রেম। দক্ষিণারঞ্জন ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। আবার একজন জঘন্য চরিত্রহীন মানুষও নন। তাঁর শরীরেও বনেদি রাজরক্ত। এই টমাস সাহেব দক্ষিণারঞ্জনের। এই পর্বটিকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তার মধ্যে সত্যের চেয়ে মিথ্যাই বেশি। তিনি একটি সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ বাজারে কাহিনি পরিবেশন করে গেছেন। সেই কাহিনিটির অনুবাদ এইরকম: মহারানি বসন্তকুমারী অতি অল্প বয়সে বিধবা ও লিতচরিত্র হন,তাঁহার দেওয়ান দক্ষিণারঞ্জনের সহিত অবৈধ প্রেমে আবদ্ধ হন এবং একদিন সুযোগ পাইয়া তাঁহার সহিত রাজবাড়ি ত্যাগ করেন। কিন্তু পথিমধ্যে রাজানুচরগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া পুনরায় রাজপ্রাসাদে আনীত হন। কিছুকাল পরে মহারানি তাঁহার বিষয়সংক্রান্ত কোনও মোকদ্দমার জন্য কলিকাতায় আগমন করেন এবং দক্ষিণারঞ্জনের সহিত মহারানি বসন্তকুমারীর তথাকথিত বিবাহ হয়। মহারানি বসন্তকুমারী তাঁহার মৃত্যুকাল পর্যন্ত দক্ষিণারঞ্জনের সহিত সহধর্মিণীর ন্যায় বাস করিয়াছিলেন। দক্ষিণারঞ্জনের অসৎ চরিত্রের জন্য তাঁহার সতীর্থগণ তাঁহার সংস্রব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।