গোপীমোহন ঠাকুরের বিশাল বংশ। তাঁর ছয় পুত্র-সূর্যকুমার, চন্দ্রকুমার, নন্দকুমার, কালীকুমার, হরকুমার ও সুবিখ্যাত প্রসন্নকুমার ঠাকুর (সি.এস.আই)। দক্ষিণারঞ্জনের জন্য আমরা গোপীমোহন ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সূর্যকুমারেই থাকব। তাঁর দুই কন্যা। ত্রিপুরাসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী। গোপীমোহন ঠাকুরের ছয়পুত্রের কথা বলা হলেও তাঁর একটি কন্যা ছিল। নাম রেখেছিলেন ব্রহ্মময়ী। এখন গোপীমোহন সম্পর্কে আরও বলার আছে। তিনি শুধু ধনী ছিলেন না। অতি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। শুধু ধনী নন তাঁকে বলা হত ধনকুবের, আবার দানবীর। তিনি ছিলেন শক্তিসাধক। সেইখানেই এলেন এক কন্যা, নাম রাখলেন ব্রহ্মময়ী–মা এসেছেন, সেই চোখেই তিনি কন্যাকে দেখতেন। স্বভাবতই পিতার সমস্ত স্নেহ কন্যার ওপর আরোপিত হল। যখন পূজায় বসতেন তখন ধ্যানদৃষ্টিতে আজ্ঞাচক্রে যে মুখটি ফুটে উঠত, সেই মুখটি কন্যা ব্রহ্মময়ীর। তিনি বলতেন আমি বিশ্বজননীকে বলেছিলুম, তুমি কন্যারূপে আমার কাছে এসো। ব্রহ্মময়ীকেই তিনি অলংকারে ভূষিত করে মা কালীকেই প্রত্যক্ষ করতেন। প্রাসাদের সর্বত্র নূপুর পায়ে ঝমঝম করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গৃহে আনন্দের হিল্লোল তুলছেন। সকলেই তাঁকে চোখে চোখে রাখতেন। সকলেই জানতেন তিনি জ্যান্ত মা।
গোপীমোহন নিজে পণ্ডিত মানুষ। তিনটি ভাষায় সমান পারদর্শী সংস্কৃত, ফারসি ও উর্দু। ইংরেজিও জানতেন। ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষাও শিখেছিলেন। মহাসমারোহে তাঁর বাড়িতে যে দুর্গাপুজো হত, আকারে প্রকারে তার কোনও তুলনা ছিল না। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্বীকৃত। দেশীয় শিল্প ও সাহিত্যের উন্নতির দিকে তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি নিজে সংগীত অনুরাগী ছিলেন। যেসব বিশিষ্ট শিল্পীর সেবা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন–কালি মির্জা (কালীদাস মুখোপাধ্যায়), ল-কে কানা (লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস), অঞ্জু খাঁ, লালা কেবল কিষণ। তিনি নিজে সুন্দর গান লিখতেন। নিজের বংশ সম্পর্কে তাঁর অত্যন্ত অভিমান ছিল। কোনওরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারতেন না। সেই মজার কলকাতায় বড়লোকদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চরিত্র ছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাজা। রাজকৃষ্ণ। শোভাবাজারের মহারাজা রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের পুত্র। হিন্দু ধর্মে তাঁর কোনও আস্থা ছিল না। হিন্দু আচার-ব্যবহার প্রকাশ্যে পদদলিত করে এক মুসলমান রমণীর সঙ্গে থাকতেন। সহবাসই বলা চলে। মুসলমান বাবুর্চি তাঁর আহারাদি প্রস্তুত করতেন। মুসলমানরাই তাঁর সভাসদ ও সহচর ছিলেন। মুসলমান কবিদের দিয়ে মহরমের গান রচনা করাতেন। প্রচুর খরচ করে মহরমে মিছিল বের করতেন। আর সেই শোভাযাত্রার একেবারে সামনে তিনি স্থান গ্রহণ করে ধার্মিক মুসলমানদের মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে পদব্রজে শহর ভ্রমণ করতেন। আসল কথা কোনও ধর্মেই তাঁর বিশ্বাস ছিল না। মুসলমানরা ভাবতেন রাজা রাজকৃষ্ণ আমাদেরই সমাজের একজন। কিন্তু হিন্দুরা এই উচ্চবংশীয় ধনী মানুষটিকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। সেই সময়কার হিন্দু দলপতিরা রাজা রাজকৃষ্ণকে হিন্দু। পৰ্বাদির উৎসবে সাদরে নিমন্ত্রণ করতেন। রাজকৃষ্ণ উপেক্ষা করতেন না। এইবার সেই কথাটি গোপীমোহনের বংশঅভিমান, তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হিন্দু পর্বের একটি শোভাযাত্রা চলেছে জাঁকজমকে ভরা। রাজা রাজকৃষ্ণও রয়েছেন। গোপীমোহন বারান্দায় বসে দেখছিলেন। থাকতে না পেরে রাজকৃষ্ণকে জিগ্যেস করলেন, রাজা আপনি কোন। দলের। কখনও দেখি হিন্দুর মিছিলে, কখনও আবার মুসলমানের। রাজা রাজকৃষ্ণ একটি চিমটি কাটা উত্তর দিলেন যাতে লুকিয়ে আছে গ্লানিসূচক একটি ভাব। অর্থাৎ তুমি তো পিরালি। রাজা হাসতে হাসতে বলছেন, সত্যিই তাই, আমাকে দু-দলেই দেখতে পাবেন। কিন্তু আপনি কোন দলে। কোনও দলেই তো আপনাকে দেখতে পাই না। আহত গোপীমোহন তাঁর পৈতেটি তুলে রাজাকে দেখিয়ে সগৌরবে বললেন, আশ্চর্য নয় রাজা, কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়, আমার স্থান যেখানে, অতটা উঁচুতে আপনি কখনওই উঠতে পারবেন না।
গোপীমোহন তাঁর বংশগৌরব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। তিনি শুধু ধার্মিক ছিলেন না, সাধনভজন করতেন। সংগীতচর্চা করতেন। দান-ধ্যান ও সংগীতের পৃষ্ঠপোষণ করতেন। –এতগুলি গুণের ধারা একত্রিত হয়ে তাঁর বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। এইটিই ঠাকুরদের বৈশিষ্ট্য। জোড়াসাঁকোয় যার বিকাশ হয়েছিল পুরোমাত্রায়।
গোপীমোহনের ঐতিহাসিক কীর্তি মূলাজোড়ে মা ব্রহ্মময়ী মন্দির। সেকালেই যত অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটত। কোথায় কলকাতা আর কোথায় মূলাজোড়। আর মা কালী পেলেন। ব্রহ্মময়ী নাম। এর অন্তরালে অদ্ভুত এক ইতিহাস। গোপীমোহন তাঁর আদরের কন্যাটিকে সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করতেন না। কন্যাটিকে রেখেছিলেন তাঁর ধ্যানে। এদিকে তাঁর খেলাধুলা ও লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। সেখানে কোনও ত্রুটি রাখেননি। পরিবারের সবাই অনুভব করেছিলেন ব্রহ্মময়ীর জন্মের পর থেকেই ঠাকুর পরিবারের যশ ও ঐশ্বর্য শতগুণ বেড়ে গেছে।
সেই সময় গৌরীদানের প্রথা ছিল। অল্পবয়সেই মেয়েদের পাত্রস্থ করা হত। স্ত্রী এবং স্বামীর বয়সের যথেষ্ট ফারাক থাকত। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির বিবাহের বয়স এবং পাত্রীর বয়সের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। সকলেই সেইকালের বিখ্যাত ব্যক্তি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চোদ্দো বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। স্ত্রীর বয়স ছিল ছয়। কেশবচন্দ্র সেন আঠারো। বছর বয়সে যাঁকে বিবাহ করলেন, তাঁর বয়স নয়। এগারো বছরের বঙ্কিমচন্দ্র বিবাহ করলেন পাঁচ বছরের এক বালিকাকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স উনিশ, স্ত্রীর বয়স আট। ভূদেব মুখোপাধ্যায় মোলো বছর বয়সে এগারো বছরের এক বালিকাকে বিবাহ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স সতেরো, পাত্রীর বয়স সাত। উনিশ বছরের নবীনচন্দ্র সেন দশ বছরের একটি কন্যাকে বিবাহ করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চোদ্দো, তাঁর স্ত্রীর বয়স আট। পনেরো বছরের অমৃতলাল বসু নয় বছরের এক বালিকাকে গ্রহণ করলেন।