নির্বিকার সন্ন্যাসী গোলাপ বাগে গিয়ে হাজির হলেন। ভেতরে ঢুকলেন না, গেটের একপাশে বসে রইলেন। অদূরেই গোপীনাথ ময়রার দোকান। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই ময়রা বলে উঠলেন, একি আমাদের ছোট মহারাজ না! সন্ন্যাসী তাকালেন। গোপীনাথ ছুটে এসে গলায় কাপড় দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল। শহরের সর্বত্র দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সংবাদ–ছোট মহারাজ ফিরে এসেছেন। চতুর্দিক থেকে পিলপিল করে লোক আসতে লাগল। ছোট মহারাজের রানিদের কানে খবরটা যেতেই তাঁরা পুরোনো এক দাসীকে পাঠালেন। দাসী ফিরে এসে চোখের জল মুছতে মুছতে বললে, আর সে বর্ণনাই, সে মূর্তি নাই, কিন্তু গাল ভরা সেই হাসিটি রয়েছে। ছিলেন মহারাজাধিরাজ আজ সন্ন্যাসী। একেই বলে মা, যে রাজ্যে রাজা ছিলেন, সেই রাজ্যে মেগে খেলেন। রাজবাড়ির পুরনো আমলারা দেখতে এলেন। তাঁদের একজন–মুহুরী, কুঞ্জবিহারী ঘোষ। রাজবাড়িতে ফিরে এসে পরাণবাবুর মেজছেলে তারাচাঁদকে বললেন, বাবু, আর দেখতে হবে না। আমাদের ছোট মহারাজ সত্যি, সত্যি ফিরে এসেছেন। তারাচাঁদ এই খবরটি বাবাকে জানালেন। পরাণবাবু সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন লেঠেলকে পাঠালেন। তাদের হম্বিতম্বিতে সন্ন্যাসী সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন কাঞ্চননগরে। পরাণবাবু ছাড়ার পাত্র নন, আবার লেঠেল পাঠালেন। তারা সন্ন্যাসীকে দামোদর পার করিয়ে দিয়ে এল। কুঞ্জবিহারীর চাকরি গেল।
সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেল অক্ষরে অক্ষরে। পরাণবাবুর ছোটছেলে তেজচাঁদ বাহাদুরের। মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন। প্রতাপচাঁদ রাজার লেঠেলদের তাড়া খেয়ে অবশেষে এলেন বর্ধমান রেল স্টেশনের উত্তরে একটি পরিত্যক্ত স্থানে। ধুনি জ্বালিয়ে কিছুদিন থাকার পর তাঁর একটি ডেরা তৈরি হয়ে গেল। তখন পরাণচাঁদ জেলাশাসককে হাত করে সন্ন্যাসীকে আবার তাড়ালেন। তুলে দিয়ে এলেন কালনার রাস্তায়। রটিয়ে দিলেন, এ মিথ্যেবাদী, একটা পয়লা নম্বরের জোচ্চোর। সাধু আর ফিরলেন না। এইবার সাধু যে জায়গায় ধুনি জ্বালিয়ে বসলেন পরবর্তীকালে সেই অঞ্চলটির নাম হল বাজে প্রতাপপুর। প্রতাপচাঁদের বন্ধু-বান্ধবের অভাব ছিল না। বিষ্ণুপুরের রাজা ক্ষেত্রমোহন সিংহ তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রতাপচাঁদের দাবি প্রমাণ করার জন্য তিনি হুগলি কোর্টে একটি মামলা দায়ের করলেন। মামলা চলল বেশ। কয়েকবছর। বহু সাক্ষী পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। মামলা দাঁড়াল না। প্রতাপচাঁদ রাজপদের অধিকার চিরতরে হারালেন।
সন্ন্যাসী প্রতাপচাঁদ মানুষের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সৌম্য চেহারা। সুমিষ্ট ব্যবহার, বহুরমণী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। প্রতাপচাঁদকে কয়েক বছরের জন্য জেলেও যেতে হয়েছিল। তিনি শান্ত গলায় বিচারপতিকে একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছিলেন–আমি এখনও বুঝতে পারলুম না, কী অপরাধে আপনি আমাকে দণ্ড দিলেন। বিচারপতি বলেছিলেন, তোমার আসল নাম আলোকশা। মহারাজাধিরাজ প্রতাপচাঁদ বলে লোক জুটিয়েছ। রাজ্যের। শান্তি নষ্ট করেছ। আমি তোমাকে কয়েক বছরের জন্য জেলে পাঠালুম। ১৮৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের যে দিনে তিনি কারামুক্ত হলেন সেদিন হুগলিতে এক মহাসমারোহ, কলকাতা থেকে বহু সম্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিতে এসেছিলেন। পরের দিনটিতে ছিল অর্ধোদয় যোগ। সেই উপলক্ষে বর্ধমান আর বাঁকুড়ার বহু পুণ্যার্থী হুগলি ও ত্রিবেণীতে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরাও সংবর্ধনায় যোগ দেন। পঞ্চকোটের রাজা ও বিষ্ণুপুরের রাজা–দুজনেই এসেছিলেন। তাঁরা জেলখানার গেটে হাজির হলেন। অঞ্চলের ধনীরা দেশি বাদ্য, ইংরেজি বাদ্য, হাতি, ঘোড়া, রেসালা নিয়ে জেলখানার সামনে হাজির। প্রতাপচাঁদ বেরনো মাত্রই হাতির ওপর স্থাপিত নহবত বেজে উঠল। চতুর্দিকে কাড়ানাকাড়ার শব্দ, হরিধ্বনি, তিন-চার দল ইংরেজি বাদ্য বেজে উঠল। সবাই মিলে প্রতাপচাঁদকে পালকির সুখাসনে বসালেন। পালকিবাহকদের কাঁধে চারজন বালক, চামর ব্যজন করছে। শতশত পতাকা আগে আগে। নগর প্রদক্ষিণ শেষ করে সাধু জাহাজে উঠলেন। চলে এলেন কলকাতায়। তাঁর থাকার। জায়গা নির্ধারিত হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণ বসাকের বাড়িতে।
প্রথমে কলকাতার চাঁপাতলা। সেখান থেকে প্রতাপচাঁদ এলেন কলুটোলার গোবিন্দ প্রামাণিকের বাড়িতে। এই ব্যক্তির আশ্রয়ে দু-তিনমাস থেকে তাঁকে নিঃস্ব করে দিলেন। গোবিন্দবাবু এই জাল রাজার ওপর জুয়ার দান ধরেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল তিনি আসল প্রতাপচাঁদ। যথাসময়ে রাজ্য ফিরে পাবেন এবং তাঁরও বরাত খুলে যাবে। প্রতাপচাঁদ এরপর গেলেন শ্যামপুকুরে। কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজ সরকার লাহোরের লড়াইতে জড়িয়ে পড়ল। সরকারের নজর পড়ল প্রতাপচাঁদের ওপর। তিনি কোম্পানির রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেলেন চন্দননগরে ফরাসিদের আশ্রয়ে। কয়েকবছর থাকার পর এলেন শ্রীরামপুরে। এইখানে তিনি হলেন ঠাকুর। সেইরকম তাঁর সাজপোশাক চালচলন। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় বেশ্যারা এসে পঞ্চপ্রদীপ আর ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে আরতি করত। তিনি জ্যান্ত ঠাকুর হয়ে সিংহাসনে বসে থাকতেন। অনেকেই ভাবলেন রাজ্যহারা রাজার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।