প্রতাপচাঁদ যখন বিষয়কর্মে মন দিলেন তখন পরাণবাবু কায়দা করে তাঁকে সেই কাজ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রতাপচাঁদ বুঝেছিলেন, এই পরাণমামা কী চাইছেন! তিনি কৌশলে তাঁর পিতার কাছ থেকে সমস্ত বিষয়ের দানপত্র লিখিয়ে নিয়েছিলেন। পরাণবাবু খুব চেষ্টা করেছিলেন সেটিকে খারিজ করাতে। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারলেন না। আর তখনই তাঁর পরমাসুন্দরী কন্যা বসন্তকুমারীকে রাজার ভোগে পাঠিয়ে দিলেন।
হঠাৎ প্রতাপচাঁদের ভীষণ পরিবর্তন এল। ইতিমধ্যে তিনি সাধক কমলাকান্তের সঙ্গলাভ করেছেন। মানসিক পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে গুটিয়ে আনছেন। হঠাৎ একদিন তিনি রাজবাড়ি থেকে অদৃশ্য হলেন। তেজচাঁদ এইবার বুঝতে পারলেন, একমাত্র এই পুত্রটির প্রতি তাঁর কী মমতা! কোথায় প্রতাপচাঁদ। একদিন এক মুসলমান আমলা এসে জানালেন, প্রতাপচাঁদের খবর তিনি জানেন। তিনি রাজমহলে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজকর্মচারীদের পাঠানো হল। তাঁরা প্রতাপচাঁদকে ধরে আনলেন। রাজবাড়িতে এলেও তাঁর বিমর্ষতা গেল না। তেজচাঁদ রোজ পুত্রকে কাছে বসিয়ে আদর করতেন, বোঝাতেন। প্রতাপ নিরুত্তর।
একদিন সকালে উঠে প্রতাপ খানসামাদের বললেন, আজ আমি নতুন মহলে চান করব। তিনি শখ করে একটি হামাম তৈরি করিয়েছিলেন। সেটি একবারও দেখতে যাননি। সেদিন কী খেয়াল হল! খানসামারা সেখানকার বিভিন্ন প্রণালীতে জল ভরে দিলেন। সবকটা ফোয়ারা খুলে দিলেন। জলের শব্দ বাইরে থেকে শোনা যেতে লাগল। প্রতাপচাঁদ তাঁর সাধের স্নানঘরে প্রবেশ করলেন। প্রায় এক প্রহর হয়ে গেল, তখনও তিনি বেরোলেন না। যখন বাইরে এলেন তখন চোখ দুটো টকটকে লাল, সারা শরীর কাঁপছে।
বিকেলেই রাজবাড়ির বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়ল–প্রতাপচাঁদ ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার-বদ্যির আসা যাওয়া। একজন মুসলমান চিকিৎসক প্রতাপের খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি তাঁরই কথা শুনতে লাগলেন। অসুখ দিন দিন বেড়েই চলল। শেষে বর্ধমানের সিভিল সার্জেন ডাক্তার কুলটার এলেন। খবর বেরোলসায়েব ডাক্তার কোনও ব্যবস্থা না করেই চলে গেছেন। ঘটনাটা ঠিক নয়, ডাক্তার কুলটার প্রতাপের কপালে দশ-বারোটা জোঁক বসাতে চেয়েছিলেন। বৃদ্ধ রাজা ও প্রতাপচাঁদ–দুজনেই আপত্তি জানানোয় ডাক্তার রাগ করে চলে গেছেন। সেকালের ডাক্তারদের প্রায় সংস্কারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল–সব ব্যাপারেই জোঁক প্রয়োগ। ইংল্যান্ডে ডাক্তারদের একটা নামই হয়ে গিয়েছিল লিক অর্থাৎ জোঁক।
সেইদিনই বিকেলের দিকে প্রতাপচাঁদ বললেন, আমার গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা করো। এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন এমন কারওরই মনে হল না। অবস্থা অতটা খারাপ নয়। কবিরাজ রাজবল্লভ এলেন। নাড়ি দেখে গঙ্গাযাত্রায় সায় দিলেন। প্রতাপকে নিয়ে যাওয়া হল কালনায়। সঙ্গে বৃদ্ধ মহারাজও রয়েছেন। আত্মীয় স্বজনদের কেউই গেলেন না; স্ত্রী লোকরা তো নয়ই। কালনায় পৌঁছে তাঁরা কয়েকদিন রাজবাড়িতে রইলেন। এইবার শেষ প্রহর। উপস্থিত। একদিন রাত দেড়টার সময় তাঁকে পালকি করে গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘাটটি ঘেরা হল কানাত দিয়ে। প্রতাপের দেহ অন্তৰ্জলিতে। গঙ্গার ঘাটে ছোটখাটো একটা ভিড়। সকলেই কানাতের বাইরে। ঘোর অন্ধকার। আট-দশটা মশাল জ্বলছে। একটা বড় জায়গার অন্ধকার এই আলোতে তেমন কাটছে না। জলের ধারে একটি তাঁবু। সেখানে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বসেছেন। পৌষ মাস, প্রচণ্ড ঠান্ডা। রাত দুটো প্রতাপ চলে গেলেন। রাত তিনটেয় চিতা জ্বলে উঠল। রাজা তেজচাঁদ বর্ধমান যাত্রা করলেন।
ভিন্ন ইতিহাসে বলা হচ্ছে, প্রতাপচাঁদ যখন মরণাপন্ন তখন তেজচাঁদের শ্যালক ও শ্বশুর পরাণচাঁদ মহারাজের ষষ্ঠ মহিষী অর্থাৎ তাঁর ভগ্নী কমলকুমারীর সাহায্যে জীবন্মত প্রতাপচাঁদকে সকার করার উদ্দেশে কালনার গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু চিতায় তুলে দাহ করার আগেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। পৌষের রাত। শ্মশান যাত্রীরা শবদেহ ফেলে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে স্থান ত্যাগ করলেন। দুর্যোগ থেমে যাওয়ার। পর এসে দেখলেন লাশ নেই। প্রতাপচাঁদের দুই স্ত্রীকে বিধবার বেশ ধারণ করানো হল। এইবার পরাণচাঁদের দ্বিতীয় চাল। তিনি তাঁর ভগ্নী মহারানি কমলকুমারীকে দিয়ে তেজচাঁদ বাহাদুরকে দত্তক পুত্র গ্রহণের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। মহারাজা কিছুতেই দত্তক গ্রহণ করবেন না। তাঁর স্থির বিশ্বাস–প্রতাপ ফিরবেই। পরাণচাঁদ ও কমলকুমারী বোঝালেন, আপনার বয়েস হয়েছে। হঠাৎ মারা গেলে উত্তরাধিকারীর অভাবে পুরো রাজতৃটাই সরকারের খাস হয়ে যাবে। তিনি চুনীলাল মতান্তরে কুঞ্জবিহারীকে দত্তক নিতে বাধ্য হলেন। রাজার মৃত্যুর পর মাহতাবচাঁদ বাহাদুর নামে বর্ধমানের সিংহাসনে অভিষিক্ত হলেন। রাজা হিসেবে তিনি অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন। প্রতাপের মৃত্যুর ঠিক চোদ্দো বছর পরে হঠাৎ এক সাধুর আবির্ভাব। বর্ধমান ইতিমধ্যে অনেক বদলে গেছে। ইংরেজরা ভালো ভালো রাস্তা তৈরি করেছেন। ধারে ধারে বিলিতি ফুলের বাগান। কৃষ্ণসায়রের পাড় ঝকঝকে তকতকে। জঙ্গল কেটে সাফ। জায়গায় জায়গায় সুন্দর সুন্দর উদ্যান। সেইসব উদ্যানের নামও খুব আকর্ষণীয়। রাজবাড়ির বাইরেটা অপরিষ্কার হলেও ভেতরে অনেক নতুন মহল তৈরি হয়েছে। চিড়িয়াখানাটা নেই। সন্ন্যাসী সোজা রাজবাড়িতে প্রবেশ করলেন। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কর্মচারীরা সব দেখেও কিছু বলছেন না। সন্ন্যাসীও নির্বাক। তিনি চলে এলেন বারমহলে। বহুঁকাল মেরামত হয়নি। দু-একটি দরজা ভাঙা। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। তিনি ঠিক করলেন–এইখানেই থাকবেন। এইবার কয়েকজন রাজকর্মচারী এসে তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন।