জেনানা মহলে বসন্তকুমারীর কী অবস্থা তা পরে জানা যাবে। তিনি যথাসময়ে প্রকাশিত হবেন তাঁর ফণা বিস্তার করে। এত বিয়ে কিন্তু ছেলে একটি। সবেধন নীলমণি প্রতাপচাঁদ। পঞ্চম পত্নী নানকিকুমারী তাঁর মা। ষষ্ঠ রানি কমলকুমারী তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র চুনীলালকে দত্তক নিয়েছিলেন। এই চুনীলাল পরাণচাঁদের পুত্র। সে তার মায়ের অষ্টম গর্ভের সন্তান। দেওয়ান পরাণচাঁদের ধারণা অষ্টম গর্ভের সন্তানদের ভাগ্য রাজভাগ্য। প্রতাপচাঁদকে হটাতে পারলেই চুনীলালের বিরাট ভবিষ্যৎ। অন্যমতে চুনীলাল নয় ছেলেটির নাম কুঞ্জবিহারী। তেজচাঁদ অনেক ভালো ভালো কাজ করেছিলেন। কিন্তু পিতা হিসেবে প্রতাপচাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। কুমার প্রতাপচাঁদ একজন উদ্ধৃঙ্খল যুবক হয়ে দাঁড়ালেন। সাঁতারে পটু, সুদক্ষ ঘোড়সওয়ার, ক্ষুরধার বুদ্ধি, অল্প বয়সেই তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়। পিতামহী মহারানি বিষণকুমারীই তাঁকে মানুষ করেন। তাঁর অতিশয় আদরে প্রতাপচাঁদ এক বেপরোয়া যুবক। কোনও ভয়ডর নেই। তেজচাঁদ বাহাদুর তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। সুরা এবং সাকি–দুটিই তাঁর অতি প্রিয়। পরে সাধক কমলাকান্তের সংস্পর্শে এসে একেবারে অন্যরকম। হয়ে গেলেন। কুস্তিগীর, লম্বা চওড়া শরীর, তিরন্দাজিতে ওস্তাদ, লেখাপড়াও করতেন। ১৮১৯ সালের বিখ্যাত অষ্টম বঙ্গ আইনের খসড়া তাঁরই তৈরি। প্রতাপচাঁদেরও দুই বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর নাম আনন্দী দেবী, দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম পেয়ারিদেয়ী দেবী।
প্রতাপচাঁদ পরাণবাবুকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তেজচাঁদের বসন্তকুমারীর। সঙ্গে বিয়ে কেউই ভালো চোখে দেখেননি, সাধারণ মানুষ বলতে লাগলেন, পরাণমামা দড়ি পাকাচ্ছেন। প্রতাপচাঁদ উঠতে বসতে খালি শুনছেন, সিংহাসনে প্রতাপচাঁদ কী করে বসেন। একবার দেখি। বসবে অষ্টম গর্ভের ওই সন্তানটি। তিনিও বলতে শুরু করলেন, তোমরা লিখে রাখো–আমার গদিতে বসবে পরাণের ছেলে। এরফলে পরাণবাবুরই সুবিধে হল।
তাঁর ষড়যন্ত্রের শেকড় আরও গভীরে চলে গেল। বসন্তকুমারীর সঙ্গে তেজচাঁদের বিয়ের আগে থেকেই দুজনের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করেছিল। বসন্তকুমারীকে ভেট দেওয়ার পর থেকে সাপে নেউলে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াল।
প্রতাপচাঁদ নিজের ভাবমূর্তি বদলাবার জন্য রাজকার্যে মন দিয়েছিলেন। সেই সময়ে। জমিদারি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত যদি না প্রতাপচাঁদ তাঁর আট আইনটি সরকারকে দিয়ে বলবৎ করাতেন। বর্ধমান রাজাদের বিরাট জমিদারি। যথাসময়ে খাজনা জমা দেওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। অতি কুখ্যাত সূর্যাস্ত আইনে জমিদারদের জমিদারি কখন যায়, কখন থাকে তার নিশ্চয়তা ছিল না। অধিকাংশ জমিদারের পরমায়ু চার বছরের বেশি হত না। প্রতাপচাঁদের মাথা থেকেই বেরোল, সরকারি খাজনা আদায় না করে জমিদারি ভাগ ভাগ করে এক-একজন জমিদারকে পত্তনি দেবেন। সূর্যাস্ত আইনের মতোই চুক্তি। ঠিক সময়ে খাজনা দিতে না পারলে সেই পত্তনি অন্য জমিদারকে নিলাম করা হবে। আর সেই টাকা থেকে মিটবে সরকারের খাজনা। এরফলে বর্ধমান রাজের জমিদারি শুধু পাকা হল না আয়ত্ত বেড়ে গেল অনেক গুণ।
একদিকে এই কৃতিত্ব অন্যদিকে প্রতাপচাঁদের উচ্ছঙ্খল স্বভাব। তেজচাঁদের কানে পরাণবাবুর ফুসমন্তর। অন্তিম সময়ে দেখা গেল পিতা-পুত্রের বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ। আট আইনের প্রণেতা প্রতাপচাঁদকে সবাই দেখলেন। এইবার প্রতাপচাঁদের আর একটি রূপ– ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্ট দেখলেই বেধড়ক পেটান। তিনি একজন ঐতিহাসিকের লেখায় পড়েছিলেন, পলাশির যুদ্ধে মিরজাফর হঠাৎ যুদ্ধ থামিয়ে না দিলে ইংরেজদের বাহাদুরি বেরিয়ে যেত। সেই রাগে বলশালী প্রতাপচাঁদ ইংরেজ রাজকর্মচারী দেখলেই পেটাতেন। একবার পথে তাঁর সঙ্গে একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের দেখা হয়েছিল। তিনি রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতাপচাঁদের গাড়ি দেখে তিনি রাস্তা ছাড়েননি। প্রতাপচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে রাস্তায় নামিয়ে আগাপাশতলা বেত দিয়ে পিটিয়েছিলেন। এই অপরাধের জন্য প্রতাপচাঁদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের হয়েছিল।
ইংরেজ রাজকর্মচারীদের পেটালেও সাহেবদের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে বসে মদ্যপান করতেন। মেদেয়িরা মদটি তাঁর ভীষণ প্রিয়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও চোস্ত ইংরেজি বলতেন। এক ইংরেজ ডাক্তার স্কটের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। রাজার ছেলে হলেও অত্যন্ত মিশুকে ছিলেন। দেশি-বিদেশি সকলের সঙ্গেই গড়ে উঠত আত্মীয়তা। তাঁর কতকগুলি আড্ডার স্থল ছিল। যেমন সালকিয়া, তেলেনিপাড়ার রামধনবাবুর বাড়ি। এই জায়গাটি ছিল ভদ্রেশ্বরে। রামধনের বৈঠকখানায় মজলিশ বসত। চুঁচড়োর রাজবাড়িতেও যেতেন। দিনেমারের গভর্নর বারবেক সাহেবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এইখানেই আর-একজন ছিলেন হাজি আবু তালিব। সিঙ্গুরের নবাববাবুর সঙ্গে তাঁর ভীষণ খাতির। মুসলমান হলেও নবাববাবু প্রতি বছর দোলের দিন বর্ধমানের ফাগ খেলতে আসতেন। একবার এত ফাগ নিয়ে গিয়েছিলেন, পনেরো দিনেও শেষ করা যায়নি। শেষে বস্তা বস্তা ফাগ বাঁকা নদীর জলে ফেলে দিলেন। নদীর জল টকটকে লাল। স্থানীয় মানুষ কয়েকদিন সেই জল ব্যবহার করতে পারেননি। নবাবের এই নবাবির পরিণাম–তাঁর স্ত্রী বৃন্দাবনে ভিক্ষে করে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন।