তেজচন্দ্র–তুমি কি সমুদয় টাকা ইহাতেই ব্যয় করিয়াছ?
মোক্তার–আজ্ঞা না মহারাজা আমাদের দেশে বড় জলকষ্ট ছিল, গোবৎসাদি দুই প্রহরের সময় একটু জল পাইত না, আমি মহারাজের টাকায় একটি বড় পুষ্করিণী কাটাইয়াছি। মহারাজের পুণ্যে তাহার জল কীরূপ আশ্চর্য পরিষ্কার ও সুস্বাদু হইয়াছে, তাহা সিপাহিদের জিজ্ঞাসা করুন।
তেজচন্দ্র–পুষ্করিণীটি প্রতিষ্ঠা করিয়াছ?
মোক্তার–আজ্ঞা না! টাকায় কুলায় নাই।
তেজচন্দ্র–এখন কত টাকা হইলে প্রতিষ্ঠা হয়?
মোক্তার–ন্যূনকল্পে আর দুই হাজার চাই।
তেজচন্দ্র–কিন্তু দেখো! খবরদার!–দুই হাজার টাকার এক পয়সা বেশি না লাগে, তাহা হইলে আর আমি দিব না।
তাহার পর পূর্বকথিত কর্মচারীকে ডাকিয়া মহারাজ বলিলেন, আমি তো মোক্তারের কোনও দোষ দেখিতে পাইলাম না। মোক্তার যাহা করিয়াছে, তাহাতে আমার টাকা সার্থক হইয়াছে। ইহা অপেক্ষা আমি আর কি ভালো ব্যয় করিতাম। কর্মচারী নিরুত্তর হইল।
তেজচাঁদ বাহাদুরের বিবাহ কাণ্ডে আসার আগে তাঁর চরিত্রের কয়েকটি বিশেষ দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে দেখে সঞ্জীবচন্দ্র যেসব মন্তব্য করেছেন। তার আড়ালে আর একটি মহৎ জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। যৌবনে তিনি একজন উচ্চাঙ্গের সাধক ছিলেন। সম্ভবত তন্ত্র। পরমশ্যামা সাধক কমলাকান্তের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বর্ধমানের বোরহাট অঞ্চলে কমলাকান্ত তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। বহুপ্রচলিত একটি লোককাহিনি আছে কমলাকান্ত মহারাজাধিরাজ তেজচাঁদকে অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন, আর সুরাকে রূপান্তরিত করেছিলেন দুগ্ধে। তেজচাঁদ বাহাদুরের আমলেই বর্ধমান শহরে রাধাবল্লভ জিউ ও অন্নপূর্ণাদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতার পেনোপোস্তা, ওল্ডচিনাবাজার, টেরেটো বাজার শ্রীশ্রী রাধাবল্লভজিউর সেবায় দান করেন। বর্ধমান রাজপ্রাসাদটিও তিনি সম্পূর্ণ করান। শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ ঠাকুরের আবির্ভাব চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য মস্ত বড় একটি কাজ করেছিলেন। বাঁকা নদীর দক্ষিণ দিকে সাধারণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য যে ভাঙা পুলটি ছিল সেটিকে সম্পূর্ণ সংস্কার করে একটি পাকা পুল নির্মাণ করান। এই পুলটি এখন আলমগঞ্জের পুল নামে পরিচিত। একটি শ্বেতপাথরের ফলকে উৎকীর্ণ আছে, ঈশ্বর রাধাবল্লভ ঠাকুরের আবির্ভাব জন্য সুখেতে প্রকাশ ইত্যাদি। তাঁর এইসব কাজে যিনি সর্বদা পাশে থেকেছেন তিনি হলেন মহিষী কমলকুমারী। তেজচাঁদের ষষ্ঠপত্নী এই কমলকুমারী।
প্রথম পত্নী জয়কুমারী দেবী। জাজপুরের মেয়ে। পিতার নাম অজ্ঞাত। দ্বিতীয় মহারানি প্রেমকুমারী। তাঁর আর একটি নাম পেয়ারকুমারী। উখরার উড়রমল শেঠের কন্যা। তৃতীয়, মহারানি সেতাবকুমারী। পিত্রালয় ফতেপুরে। লালা বাহাদুর সিংহের ভগিনী কন্যা, চতুর্থ মহারানি তেজকুমারী দেবী, পঞ্চম, মহারানি নানকীকুমারী দেবী, পিতার নাম পাঞ্জাব রায় ট্যান্ডন। তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন প্রতাপচাঁদ। যাঁকে নিয়ে তোলপাড় ইতিহাস। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুসন্ধানমূলক গ্রন্থ জাল প্রতাপচাঁদ। ষষ্ঠ পত্নী, মহারানি কমলকুমারী দেবী। তাঁর বিবাহ বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। মহারাজা তেজচাঁদ তখন মধ্যবয়সি। সঞ্জীবচন্দ্রের বিশেষণে বর্ধমানের বুড়ো রাজা। তিনি জাল প্রতাপচাঁদ-এ লিখছেন, মহারাজ একদিন একটি দরিদ্র বালিকাকে পথে খেলিতে দেখিলেন, বালিকা পরমা সুন্দরী। মহারাজ তৎক্ষণাৎ তাহার পিতার সন্ধানে লোক পাঠাইলেন। তোক আসিয়া বলিল। পিতার নাম কাশীনাথ, জগন্নাথ দর্শনে যাইবে বলিয়া সপরিবারে লাহোর হইতে এখানে আসিয়াছে। জাতিতে ক্ষত্রিয়। মহারাজের আর বিলম্ব সইল না, দরিদ্রকে অর্থলোভ দেখাইয়া কন্যাটিকে বিবাহ করিলেন। তিনিই মহারানী কমলকুমারী। রাজবাড়ির তথ্য একটু অন্যরকম–সঞ্জীবচন্দ্রের বর্ণনায় আছে দরিদ্রের কন্যা রাস্তার খেলা করছিলেন, আসল ঘটনা খেমচাঁদ কাপুর তাঁর ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে পুরীতে জগন্নাথ দেবকে দর্শন করতে যাচ্ছিলেন। কেশবগঞ্জের চটিতে তাঁরা যখন বিশ্রাম করছিলেন সেই সময়ে তেজচাঁদ বাহাদুর কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মেয়েটির ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ল। তিনি এতটাই উতলা হলেন যে, তাঁর বাবাকে প্রচুর অর্থে সন্তুষ্ট করে মেয়েটিকে বিবাহ করলেন। পুরো পরিবারটি বর্ধমানে আশ্রয় পেল। এই কমলকুমারীর ভাই পরাণচাঁদ, তিনি এইবার বেশ জাঁকিয়ে বসলেন। হয়ে গেলেন দেওয়ান। সঞ্জীবচন্দ্রের লেখায়, প্রায়ই উল্লেখ পাওয়া যাবে কুচুটে, ষড়যন্ত্রকারী পরাণবাবুর। তেজচন্দ্রকে অতিষ্ঠ করে তোলার মতো একটি চরিত্র। তাঁরই উৎপাতে মহারাজার একমাত্র পুত্র প্রতাপচাঁদ কোথায় হারিয়ে গেলেন। কাটোয়ার গঙ্গার তীরে তাঁর অন্তর্জলি হল। তাঁকে দাহ করাও হল। কিন্তু সতেরো বছর পরে তিনি আবার ফিরে এলেন। শুরু হল মামলা। সঞ্জীবচন্দ্রের বইয়ের উপাদান–জাল প্রতাপচাঁদ।
পরাণচাঁদ কাপুর এইবার বর্ধমানের রাজগৃহে তাঁর জাল বিস্তার করলেন। তেজচাঁদের তখনও নিবৃত্তি আসেনি। কমলকুমারীকে বিয়ের পরেই ঘনশ্যাম চাঢ্যের কন্যা উজ্জ্বলকুমারীকে বিবাহ করলেন। পত্নীর সংখ্যা দাঁড়াল সাত। এরপর দেওয়ান পরাণচাঁদ ফেললেন পাশার শেষ দান। তাঁর বালিকা কন্যাটিকে নিবেদন করলেন তেজচাঁদের পত্নীকুলে। তিনি হলেন অষ্টম ও শেষ মহারানি। নাম বসন্তকুমারী। তিনি তখন চলিত বাংলায় বলতে গেলে কচি খুকি, পিতা পরাণচাঁদের দুষ্ট অভিসন্ধি পূরণের জন্য তিনি বলিপ্রদত্ত হলেন। কী কাণ্ড! পরাণচাঁদ তেজচাঁদের শ্যালক এবং শ্বশুর ও দেওয়ান।