মারাঠা আক্রমণে কাটোয়া সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে কেউ ছিল না বললেই চলে। গ্রাম ছেড়ে মানুষ পালিয়েছিল বনে বাদাড়ে, জলায় (ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ারে সেই খবর আছে)। মহারাজা তিলকচাঁদের সময় যথেষ্ট উদ্বেগপূর্ণ। তাঁর দুই বিবাহ। প্রথম স্ত্রীর নাম বিষণকুমারী দেবী। তাঁরই পুত্র মহারাজ তেজচাঁদ বাহাদুর। দুই কন্যা–তোতাকুমারী ও চিত্রকুমারী। বর্ধমান শহরের বিখ্যাত রানিসায়র সরোবরটি বিষণকুমারী দেবীর কীর্তি। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রূপকুমারী দেবী। তিনি নিঃসন্তান। এ ব্যাপারে সামান্য মতভেদ আছে। কারও মতে রূপকুমারীই প্রথম স্ত্রী। মহারাজ তিলকচাঁদ রেকাবি বাজার এলাকায় বর্তমান রাজপ্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু করান। তাঁরই সময়ে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ ও ভুবনেশ্বর মহাদেবের মন্দির দুটিও নির্মিত হয়। রাজপ্রাসাদ অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি দেহত্যাগ করেন ১৭৭১ সালে। এই সময়েই সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। রাজকোষ শূন্য। রাজবাড়ির জিনিসপত্রও বিক্রি করতে হয়েছে। পারলৌকিক ক্রিয়ার অর্থ চাইতে হয়েছে ইংরেজ সরকারের কাছে। এরপরে। ক্ষমতায় এলেন তেজচাঁদ। বর্ধমানের এক বর্ণময় চরিত্র।
তেজচাঁদ যখন ক্ষমতায় বসলেন তখন তিনি নাবালক। তাঁর মা বিষণকুমারী দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের ফরমান নিয়ে রাজকার্য চালাতে লাগলেন। তাঁর অপূর্ব দক্ষতায় রাজভান্ডার। আবার ভরে উঠল। তাঁর খরচের বহর দেখলেই বোঝা যেত সুদিন ফিরেছে। সেইকালে এক লক্ষ টাকারও বেশি খরচ করে নবাব হাটে একশোনটি শিবমন্দির তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার দিন সারা ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে এক লক্ষেরও বেশিব্রাহ্মণ পণ্ডিত এসেছিলেন। মহারাজা তেজচাঁদ নিজে ব্রাহ্মণদের পদপ্রক্ষালন ও পদরজ সংগ্রহ করেন। অবশ্যই ঐতিহাসিক কীর্তি। এই মন্দির সমন্বয় বর্ধমানের পশ্চিমদিকে জিটি রোড ও সিউড়ি রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত। আজও হাজার হাজার মানুষ শিবরাত্রির দিন সেখানে সমবেত হন। পরবর্তীকালে বিড়লা স্ট্রাস্ট এটির সংস্কার করেন। ১৭৭৯ সালে তেজচাঁদ সাবালক হলেন। ১৭৯৩ সালে ইংরেজ সরকার একটি আইন প্রণয়ন করলেন–Regulation one, মহারাজের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের চুক্তি হল। রাজস্ব ধার্য হল, ৪০,১৫,১০৯ সিক্কা। আর পুলবন্দি বাবদ ১,৯৩,৭২১ সিক্কা। আবার সেই এক ব্যাপার, দুর্ভিক্ষের জন্য মহারাজার পক্ষে রাজস্বের পুরো টাকা মেটানো সম্ভব হল না। জমিদারির কিছু অংশ বিক্রি হয়ে গেল। কিনলেন সিঙ্গুরের দ্বারিকনাথ সিংহ, ভাসতারার ছকু সিংহ, জনাইয়ের বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ। অবশেষে পত্তনি প্রথা চালু করে তেজচাঁদ জমিদারি রক্ষা করলেন।
অনেক ভালো কাজ তিনি করেছেন। ১৮১৭ সালে বর্ধমানে একটি অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল স্থাপন করেন। পরে মহতাব চাঁদ এটিকে হাইস্কুল এবং ১৮৮১ সালে এটিকেই উন্নিত করলেন আই.এ.কলেজে।
তেজচাঁদের অন্য জীবন। তিনি বিলাসী এবং ভোগী। একবার নয়, আটবার বিবাহ করেছিলেন। প্রখ্যাত লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন–শিরোনাম, তেজচাঁদ বাহাদুর (বর্ধমানের বুড়া রাজা)–প্রতিদিন প্রাতে দেওয়ান, মোসাহেব ও অন্যান্য কর্মচারীরা। অন্দরমহলের দ্বারে আসিয়া তেজচাঁদ বাহাদুরের বহির্গমন প্রতীক্ষা করিতেন; তিনি যথাসময়ে এক স্বর্ণপিঞ্জর হস্তে বহির্গত হইতেন, পিঞ্জরে কতকগুলি লাল নামা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষী আবদ্ধ। থাকিত, তিনি তাহাদের ক্রীড়া ও কোন্দল দেখিতে দেখিতে আসিতেন। সমুখবর্তী হইবা মাত্র তাঁহাকে সকলে অভিবাদন করিত, মহারাজা হাসিমুখে তাহাদের আশীর্বাদ করিতেন। একদিন প্রাতে তিনি পিঞ্জর হস্তে অন্দরমহল হইতে বহির্গত হইতেছেন, এমন সময় একজন প্রধান কর্মচারী অগ্রসর হইয়া করজোড়ে নিবেদন করিল মহারাজ, হুগলিতে খাজনা দাখিল করিবার নিমিত্ত সে দিবস যে এক লক্ষ টাকা পাঠানো হইয়াছিল, তাহা তথাকার মোক্তার। আত্মসাৎ করিয়া পলাইয়াছে। তেজচাঁদ বিরক্ত হয়ে উত্তর করিলেন, চুপ! হামরা লাল ঘবরাওয়েগা! এক লক্ষ টাকা গেল শুনিয়া তাঁহার কষ্ট হইল না, কিন্তু কথার শব্দে লালপক্ষী। ভয় পাইবে, এই জন্য তাঁহার কষ্ট হইল। এই মনে করিয়া কর্মচারী বড় রাগ করিলেন, পাপিষ্ঠ মোক্তারকে সমুদয় টাকা উদগীরণ করাইব, নতুবা কর্মত্যাগ করিব এই সঙ্কল্প করিলেন। মোক্তারের অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। কিছুকাল পরে সংবাদ আসিল যে, মোক্তার আপন বাটিতে বসিয়া পুষ্করিণী কাটাইতেছে, দেউল দিতেছে, আর যাহা মনে আসিতেছে তাহাই করিতেছে। তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য রাজ্যসরকার হইতে সিপাহি ও হাওয়ালদার বাহির হইল। কিন্তু রাজা তেজচাঁদ প্রথমে তাহা জানিতেন না; কিছুদিন পরে তাহা শুনিয়াছিলেন। মোক্তার ধৃত হইয়া রাজবাটীতে আনীত হইলে তেজচাঁদ বাহাদুর মোক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলেন :
তুমি আমার এক লক্ষ টাকা চুরি করিয়াছ?
মোক্তার–না, মহারাজ, আমি চুরি করি নাই, আমি তাহা বাটীতে লইয়া গিয়াছি।
তেজচন্দ্র–কেন লইয়া গেলে?
মোক্তার–মহারাজের কার্যে ব্যয় করিব বলিয়া লইয়া গিয়াছি। আমাদের গ্রামে একটিও শিবমন্দির ছিল না, কুমারীরা শিবমন্দিরে দীপ দানের ফল পাইত না, যুবতীরা শিবপূজা করিতে পাইত না। এক্ষণে মহারাজের পুণ্যে তাহা পাইতেছে। আর, একটি অতিথিশালা করিয়াছি, ক্ষুধার্ত পথিকেরা এখন অন্ন পাইতেছে।